প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড, মুহাম্মদ ইউনুস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একই দিন গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় এ-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার অবসান ঘটল। জুলাই সনদ অনুমোদনে গণভোট নিয়ে দানা বেঁধে উঠেছিল রাজনৈতিক সংকট। বিএনপিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের প্রস্তাব দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল, গণভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। ফলে প্রথমে গণভোট হলে খুব কমসংখ্যক ভোটার তাতে অংশ নেবে। এর ফলে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা সে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পাবে। গণভোটের সূত্র ধরে কোনোভাবে জাতীয় নির্বাচন পেছালে বিদ্যমান সংকট আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। আলাদাভাবে গণভোটের আয়োজনও ব্যয়বহুল বলে বিবেচিত হতো।
জট বেঁধেছিল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন নিয়ে। এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। কারণটি খুব স্পষ্ট। এতে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। যেমনটি হয়েছে নেপালসহ বিভিন্ন দেশে। আমাদের জানা মতে, এশিয়ায় প্রথম পিআর পদ্ধতি চালু হয় ইসরায়েলে। সংস্কার সংলাপের সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে বেশির ভাগ দল ওই প্রস্তাবের ওপর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত আরও কিছু প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর এর বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলারও সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির দাবিতে ছিল অনড়। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতেও তারা ছিল অটল। এজন্য সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল।
জুলাই সনদ একটি সুবিস্তৃত বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে তো দূরের কথা, রাজনৈতিক সচেতন মহলের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের আগে গণভোট হলে তাতে অতীতের তিনটি গণভোটের মতো ভোটারশূন্য অবস্থার উদ্ভব ঘটত। এর ফলে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর গত দেড় দশকে যে আস্থাহীনতা গড়ে উঠেছে তা আরও জেঁকে বসত। জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণও তাতে হ্রাস পেত। প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট ঘোষণা সে সংশয়ের ইতি ঘটিয়েছে।
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হলে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হবে বলে আশা করা যায়। প্রার্থীরা নিজেদের স্বার্থে ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়, সে ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করবেন। এর ফলে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে। ভোটাররা তাদের প্রার্থী নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোটেও মতামত দেওয়ার সুযোগ পাবেন। বিশাল অঙ্কের অর্থ অপচয় থেকে দেশ রক্ষা পাবে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের অর্ধশত বার্ষিকীর তিন দিন আগে বিএনপি ৩০০ আসনবিশিষ্ট জাতীয় সংসদের ২৩২টি আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দেশের প্রতিটি আসনে গড়ে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল পাঁচ থেকে ছয়। সবাই সুযোগ্য এবং দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। এদের মধ্য থেকে দলের প্রয়োজনে সময়ের বিচারে যাদের দরকার, শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের মনোনয়ন দিয়েছেন। প্রতিটি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা প্রায় হাফ ডজন হলেও তাদের সবাই স্বাধীনতার ঘোষক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সৈনিক। বিএনপির চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিএনপি এমন একটি দল যে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শহীদ জিয়ার গড়া দলকে নিজেদের অস্তিত্বের অংশ বলে বিবেচনা করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দলের প্রার্থী ঘোষণের পর সবারই কর্তব্য ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের জয় নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের এককাতারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, প্রার্থীদের সবাই শহীদ জিয়ার অনুসারী, খালেদা জিয়ার সৈনিক, বিএনপির কর্মী, ধানের শীষের সমর্থক। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ধানের শীষ জিতলেই কেবল তারা নিজেদের জয়ী ভাবতে পারবেন। ধানের শীষ জিতলেই জয়ী হবে দেশ এবং গণতন্ত্র।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নির্বাচন কমিশন যথাসময়ে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে গণতন্ত্রকামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি যথাসম্ভব সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। এর অংশ হিসেবে দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৩২টিতে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি আসনে বিএনপির সুযোগ্য একাধিক প্রার্থী থাকলেও তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের রাজপথের সঙ্গী মিত্র দলগুলোর জন্যও বেশ কিছু আসনে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির দলীয় প্রার্থীদের মতো দলসমর্থিত প্রার্থীদের জয়ী করে আনতে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। আগামী নির্বাচন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। এ নির্বাচনকে খাটো করে দেখা যাবে না। গণতন্ত্র উদার ও সহনশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখে। মৌলবাদ বা উগ্রবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব এক চিরন্তন সত্য। আগামী নির্বাচনে গণতন্ত্রের স্বার্থে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষের শক্তির জয় নিশ্চিত করতে হবে। একাত্তর ও চব্বিশের পরাজিত শক্তি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে অশুভ ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। কিন্তু দেশে নির্বাচিত সরকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। গণতন্ত্রও এখনো ফিরে আসেনি। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বিজয় নস্যাৎ করতে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা উঠেপড়ে লেগেছে। অশুভশক্তির ষড়যন্ত্র রোধে বাংলাদেশকে যারা একমাত্র ঠিকানা ভাবেন, তাদের সতর্ক থাকতে হবে। সবারই জানা, বিএনপির বিজয় ঠেকাতে পতিত স্বৈরাচার দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বিগত ১৫ বছরে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। উদ্বেগ এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশেও বিএনপির বিজয় ঠেকাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের শাসনামলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ ছিল না। কয়েক কোটি তরুণ ভোটার প্রথম ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ। সর্বস্তরের মানুষ গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে কবে আসবে তাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের দিন। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের মানুষ নির্বাচনপ্রিয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চালাতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তোলা হয়েছিল নির্বাচন বিলম্বিত করতে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ মতলববাজদের সে অপচেষ্টাকে আপাতত থামিয়ে দিয়েছে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের অংশীজনদের দ্বন্দ্বে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছিল। নির্বাচন ও গণভোটসংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র রুখতে সাহায্য করবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস