আজ ১৭ নভেম্বর, উপমহাদেশের সংগীত জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি রুনা লায়লার জন্মদিন। জীবনের ৭৩তম বসন্তে পা রাখা এই চিরসবুজ গানের পাখিটি দীর্ঘ ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান গেয়ে সংগীতপ্রেমী কোটি শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছেন। সময় গড়িয়ে গেলেও ‘বন্ধু তিন দিন’, ‘আল্লাহ মেঘ দে’, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’, ‘ইস্টিশনে রেলগাড়িটা’, ‘সাধের লাউ’ এবং ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র মতো জনপ্রিয় গানগুলোর মুগ্ধতা এতটুকুও কমেনি।
সংগীতে হাতেখড়ি
১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান সিলেট অঞ্চল) এক সংগীতঘনিষ্ঠ পরিবারে জন্ম হয় রুনা লায়লার। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা অমিতা সেন (আমিনা লায়লা) ছিলেন একজন গায়িকা। প্রখ্যাত গায়িকা আঞ্জুমান আরা ছিলেন তার ভাগনি। বড় বোন দীনা লায়লার সংগীত প্রতিভার কারণে বাসায় ওস্তাদ রাখা হয়েছিল, কিন্তু দীনার পাশে বসে দেখেই গানের প্রতি রুনার আকর্ষণ জন্মে। মা-বাবা তাকে নৃত্যে পারদর্শী করতে চেয়েছিলেন, তাই চার বছর বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ‘কত্থক’ ও ‘ভরতনাট্যম’-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিলেও তার মন পড়ে থাকত গানে। ওস্তাদ আবদুল কাদের ভূপালির তত্ত্বাবধানেই তার গানের জীবনের শুরু।
মঞ্চে প্রথম পদার্পণ ও প্লেব্যাক যাত্রা
১২ বছর বয়স পর্যন্ত তার প্রতিভা পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। করাচির একটি আন্তবিদ্যালয় গানের প্রতিযোগিতায় বোনের বদলে গান গেয়ে তিনি প্রথম হন। সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে রুনা লায়লা বলেছিলেন, ‘সেদিন আমি আমার চেয়ে দ্বিগুণ বড় সেতার নিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত গেয়েছিলাম।’ তার এই প্রতিভা দুই বছর পর কাজে লাগে, যখন ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ‘জুগনু’তে একটি ১২ বছরের ছেলের কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। গানের শিরোনাম ছিল ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। সংগীত পরিচালক মনজুর হোসেনের নিবিড় প্রশিক্ষণে তার ঈশ্বর-প্রদত্ত কণ্ঠ প্লেব্যাকের জন্য প্রস্তুত হয়। ‘জুগনু’তে প্লেব্যাক শিল্পী হওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর উর্দু চলচ্চিত্র ‘হাম দোনো’-এর জন্য ‘উনকি নাজরোসে মোহাব্বাতকা জো পেয়গাম মিলা’ গজল গেয়ে তিনি আরও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
বাজমে লায়লা ও নতুন ধারা সৃষ্টি
১৯৭০ সালের মধ্যেই রুনা লায়লা প্রায় ১০০০টি গান রেকর্ড করে ফেলেন। ১৯৭২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি করাচি টিভিতে নিজের গানের অনুষ্ঠান ‘বাজমে লায়লা’ শুরু করেন। সেই সময়ে গান গাওয়া মানে শুধু গান গাওয়াই ছিল। কিন্তু রুনা লায়লা সর্বপ্রথম গানের ক্ষেত্রে গায়কের শরীর ও অঙ্গভঙ্গির একটি ভূমিকা আছে, তা শেখান। যাকে আমরা ‘পারফর্ম’ করা বলি, তিনি তা-ই করেছিলেন সেই ষাটের দশকে।
আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব
বাজমে লায়লাতে তিনি প্রায়ই শাড়ি, প্যান্ট-শার্ট বা ম্যাক্সি পরে আসতেন, যা ছিল সেই সময়ের জন্য অভাবনীয় এবং আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।
বিশ্বজয়ী ‘দামদাম গার্ল’
১৯৭৪ সালে উর্দু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে বাবার পরামর্শে সপরিবারে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তার প্রস্থানের শোকে ‘ডন’ পত্রিকা ‘অ্যান্ড টু এ গ্লোরিয়াস চ্যাপটার’ শিরোনামে সংবাদ ছাপায়। দেশে ফেরার পর সে বছরই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনশিপসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে ভারত সফর করেন। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে হিন্দি ছবি ‘এক সে বারকার এক’র টাইটেল সং প্লেব্যাক ছিল তার প্রথম হিন্দি গান। এরপর ‘দামাদাম মাস্ত কালান্দার’ গানটি তাকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা, যার জন্য ভারতে তার নাম হয় ‘দামদাম গার্ল’।

বহু ভাষার গানে পারদর্শিতা
বাংলা, হিন্দি, উর্দু ছাড়াও তিনি গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালীয়, স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজিসহ ১৭টি ভাষায় গান গেয়েছেন। এটি বিশ্ব সংগীতাঙ্গনে এক বিরল কৃতিত্ব।
গিনেস বিশ্বরেকর্ড ও গোল্ডেন ডিস্ক
মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে পাকিস্তানি সুরকার নিসার বাজমির ৩০টি গান মাত্র তিন দিনে রেকর্ড করে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখান। এটি পৃথিবীর এক দিনে রেকর্ড করা সবচেয়ে বেশি গানের জন্য এক অনন্য রেকর্ড। ১৯৮২ সালে বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে লন্ডনের বিখ্যাত অ্যাবি রোড স্টুডিওসে (যেখানে বিটলস তাদের গান রেকর্ড করত) তার পপ অ্যালবাম ‘সুপারুনা’ তৈরি করেন। মুক্তির দিনই এই অ্যালবামের ১ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল, যার জন্য তিনি গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড পান। উপমহাদেশের কোনো শিল্পী এর আগে এই সম্মান পাননি।
অর্জন ও নতুন ভাবনা
এ পর্যন্ত তিনি ৩০০টিরও বেশি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ছয়বার বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, ভারতের স্যায়গাল অ্যাওয়ার্ড, দুবার পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরোজা বেগম স্মারক স্বর্ণপদক। তিনি গান গাওয়ার পাশাপাশি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসেও তিনি সংগীতকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। তবে ইদানীং গান গাওয়ার চেয়ে সুর করতেই বেশি পছন্দ করেন এবং সুরকার হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তারই সুরে কণ্ঠ দিয়েছেন আশা ভোঁসলে, হরিহরণ, রাহাত ফতেহ আলী খানসহ বর্তমান প্রজন্মের একাধিক শিল্পী। স্বামী অভিনেতা আলমগীরের ছবি ‘একটি সিনেমার গল্প’র জন্যও তিনি গান কম্পোজ করেছেন। নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ার নিয়ে রুনা লায়লা বলেন, ‘আর্টিস্টরা হচ্ছেন বাতাসের মতো... আমি নিজেকে ছিন্নমূল ভাবি না, আমি বরং পুরো বিশ্বেরই অন্তর্গত।’
নবীন শিল্পীদের প্রতি পরামর্শ
তিনি নবীনদের প্রতি বলেন, এক-দুই দিনের খ্যাতিতে ভুলে না গিয়ে গানকে জীবনের অংশ ভাবতে শেখা উচিত এবং উৎসাহ পেলে তারা আরও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবে।
পুরোনো রুনা নতুন রূপে
সম্প্রতি কোক স্টুডিওতে জনপ্রিয় গান ‘মাস্ত কালান্দার’ পরিবেশন করে অনুরাগীদের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।
বাংলাদেশের ব্র্যান্ড রুনা লায়লা
রুনা লায়লা নাম নয়, এক চিরন্তন সুরের প্রতিচ্ছবি। তার সুরের জাদুতে বুঁদ হয়ে আছেন কোটি কোটি সংগীতপ্রেমী শ্রোতা-দর্শক। তার ৭৩তম জন্মদিনে রইল অশেষ শুভকামনা। তিনি আরও সুন্দর গান উপহার দিন-এই প্রত্যাশা।