ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহের মধ্যে নামাজ সর্বোচ্চ গুরুত্বের অধিকারী। শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, একজন অভিভাবক, পরিবারপ্রধান ও নেতা হিসেবে তার অধীনস্থদের নামাজের প্রতি যত্নবান হতে বলা ইসলামের নির্দেশিত দায়িত্ব। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা নামাজের আদেশ এবং পরিবারের প্রতি নামাজে তাকিদ— এই দুটি বিষয়কে পৃথক নির্দেশনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, নামাজ আদায় করা যেমন ব্যক্তিগত দায়িত্ব, তেমনি পরিবার-পরিজন ও অধীনস্থদের নামাজে সচেতন করা সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষত শিশুদের ছোটবেলা থেকে নামাজের প্রতি অভ্যস্ত করা, তাদের প্রতি স্নেহময় শাসন প্রয়োগ এবং পরিবারে নেক আমলের পরিবেশ তৈরির বিষয়ে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া, পানি ছিটিয়ে নামাজে উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি বিষয় পরিবারে পারস্পরিক তাকওয়া, সহমর্মিতা ও ইবাদতপরায়ণতা গড়ে তোলে। নিম্নে এ বিষয়ে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা, শিক্ষামূলক শাসনপদ্ধতি এবং নামাজে উদ্বুদ্ধ করার বাসবমুখী উপায় আলোচিত হয়েছে।
পরিবার-পরিজনকে নামাজের নির্দেশনা প্রদান : মুসলমানের জন্য নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ, তেমনি পরিবার-পরিজন ও অধীনস্থদের নামাজের প্রতি যত্নবান হতে বলাও একটি দায়িত্ব।
কোরআনুল কারিমে দুটি পৃথক নির্দেশ রয়েছে— ১) পরিবারকে নামাজের আদেশ দেওয়া ও ২) নিজে নামাজ আদায়ে অবিচল থাকা। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এই দুটির ফলাফল হিসেবে আল্লাহ এমন প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা হৃদয়কে উত্ফুল্ল করে। যেমন— প্রথমত. নামাজ আদায় করলে রিজিকের ঘাটতি হবে না। বরং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ইবাদতে মনোযোগী হলে তিনি অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিজিক প্রদান করবেন।
কাজেই মানুষের নিজের জ্ঞান, মর্যাদা বা পরিশ্রমের ওপর ভরসা করে ইবাদত ছেড়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বরং নামাজ কায়েম করলেই মহান আল্লাহ রিজিক সহজ করে দেবেন। দ্বিতীয়ত, নামাজ মানুষকে তাকওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাকওয়াই দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন, ‘এবং নিজ পরিবারবর্গকে নামাজের আদেশ করো এবং নিজেও তাতে অবিচলিত থাকো। আমি তোমার কাছে রিজিক চাই না। রিজিক তো আমিই দেব। আর শুভ পরিণাম তো তাকওয়ারই।’
(সুরা : ত্ব-হা, আয়াত : ১৩২)
ছোটবেলা থেকে নামাজের প্রতি অভ্যস্ত করা : অভিভাবকের দায়িত্ব হলো সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নামাজের প্রতি অভ্যস্ত করা। এ বিষয়ে রাসুলুুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। সাত বছর বয়সে সন্তানদের নামাজের নির্দেশ দিতে হবে, অভ্যাস করাতে হবে এবং উৎসাহ দিতে হবে। ১০ বছর বয়সেও তারা অবহেলা করলে হালকা ও শিক্ষামূলক শাসন করা যেতে পারে। এ শাসন কঠোর শাস্তি নয়; বরং নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ইবাদতের অভ্যাস দৃঢ় করার জন্য স্নেহপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত তাগিদ।
আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর বাবা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও। ১০ বছর হলে প্রয়োজনে নামাজের জন্য প্রহার করো। আর তাদের শোয়ার জায়গা পৃথক করে দাও।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)
নামাজে উৎসাহ প্রদানে সামান্য কঠোরতা : যে পরিবারে পরস্পরকে নেক আমলে জাগিয়ে তোলা হয়, সেখানে আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। ঘুম থেকে ওঠাতে পানি ছিটানোর প্রসঙ্গ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এটি সহানুভূতিশীল উৎসাহ, কঠোরতা নয়। অর্থাৎ জোর না করে, ঝগড়া না করে, নম্রভাবে নামাজে উদ্বুদ্ধ করা। পরিবারে পরস্পরকে নেক আমলের দিকে ধাবিত করা একটি মহান সুন্নাত। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে রহমত করুন, যে নিজে রাতে সালাত আদায় করতে দাঁড়িয়েছে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়েছে, সে যদি দাঁড়াতে অস্বীকার করে তার মুখে পানি ছিটিয়েছে। আল্লাহ ওই নারীকেও রহমত করুন, যে নিজে রাতে সালাত আদায় করতে দাঁড়িয়েছে এবং তার স্বামীকে জাগিয়েছে, যদি সে দাঁড়াতে অস্বীকার করে তার মুখে পানি ছিটিয়েছে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫০)
পরিশেষে বলা যায়, পরিবার-পরিজনকে নামাজে উদ্বুদ্ধ করা শুধু উপদেশমূলক দায়িত্ব নয়; এটি কোরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রণীত একটি ইতিবাচক সামাজিক দায়িত্ব। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে পরিবারকে নামাজের আদেশ দেওয়া এবং নিজে নামাজে অবিচল থাকা—উভয়ই ঈমানি জীবনের মৌলিক অঙ্গ। এর ফলাফল হিসেবে আল্লাহ পৃথিবীর জীবনকে সহজ করে দেন, রিজিকের দরজা খুলে দেন এবং তাকওয়ার মাধ্যমে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য নিশ্চিত করেন।
অতএব মুসলিম পরিবারে ইবাদত ও তাকওয়াভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করা, সন্তানদের শৈশব থেকেই নামাজের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক নেক আমলে সহযোগিতা করা এসবই একটি সফল, সুষ্ঠু ও কল্যাণমুখী পারিবারিক জীবনের ভিত্তি। নামাজ শুধু ব্যক্তিগত দায় নয়; এটি পরিবার, সমাজ ও উম্মাহর সামগ্রিক উন্নতির পথপ্রদর্শক।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন