দৈনন্দিন জীবনে নবীজি (সা.)-এর সুন্নতগুলো অত্যন্ত উপকারী ও কল্যাণকর। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এমন ১০টি সুন্নত হলো—
১. হাত ধোয়া : নবীজি (সা.) খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতেন, এমনকি তিনি খাওয়ার পর কুলিও করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) পানাহারের ইচ্ছা করলে, তাঁর উভয় হাত ধুয়ে নিতেন। এরপর খাবার গ্রহণ করতেন কিংবা পান করতেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৮)
উপকার : ১. জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া দূর হয়, ২. হজমের সমস্যা দূর করে, ৩. খাদ্যের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অক্ষুণ্ন থাকে, ৪. কুলি করলে মুখগহ্বর ও দাঁতে আটকে থাকা খাদ্যকণা দূর হয় এবং দাঁত ও পাকস্থলী ভালো থাকে।
২. খাদ্য গ্রহণে সংযম : মহানবী (সা.) খাদ্য গ্রহণে সংযম শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিয়ন্ত্রিত খাবার মানুষের দেহে নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে। মিকদাম ইবনে মাদিকারাব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষ পেট থেকে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না।
মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)
উপকার : খাদ্য গ্রহণে সংযম স্থূলতা, এসিডিটি গ্যাস্ট্রিক, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও লিভারের রোগগুলো থেকে রক্ষা করে।
৩. মিসওয়াক করা : মহানবী (সা.) দাঁত ও মুখের পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
হাদিসের বর্ণনা অনুসারে তিনি ঘুমের আগে ও পরে, ঘরে প্রবেশের সময় ও অজুর আগে মিসওয়াক করতেন। তিনি মুমিনদের প্রত্যেক অজুর আগে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টের আশঙ্কা না থাকত আমি তাদের প্রতি প্রত্যেক অজুর সময় মিসওয়াক করার আদেশ করতাম।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৮৭)
উপকার : দাঁত পরিষ্কার রাখে, মাড়ি মজবুত করে, পাকস্থলী ভালো রাখে এবং হজমে সাহায্য করে।
৪. সকালে হাঁটা : ইসলাম সকালের নির্মল পরিবেশে হাঁটতে উৎসাহিত করেছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আসলাম (রা.)-কে বলেন, ‘হে আসলাম! তুমি বের হও, বাতাসে শ্বাস নাও এবং পাহাড়ের চূড়ায় (নির্মল পরিবেশে) আবাস গড়ো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৫৫৩)
মসজিদে নববী থেকে মসজিদে কুবার দূরত্ব প্রায় সোয়া তিন কিলোমিটার। নবীজি (সা.) মাঝেমধ্যে মসজিদে কুবায় যেতেন। তিনি হেঁটে ও আরোহণ করে সেখানে যেতেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন।
(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৬৯৮)
উপকার : সকালের নির্মল বাতাসে হাঁটলে শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ে; হজম ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটা মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। সকালের রোদ ভিটামিন ডি-এর অভাব দূর করে।
৫. কায়লুলা : কায়লুলা হলো দুপুরের খাবার গ্রহণের পর সামান্য বিশ্রাম গ্রহণ করা। নবীজি (সা.) কায়লুলা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমরা নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করতাম, এরপর কায়লুলা (দুপুরের বিশ্রাম) করতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৪১)
অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমাও। কেননা শয়তান কায়লুলা করে না।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস : ২৮)
উপকার : স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, দুপুরে অল্প সময় ঘুমালে শরীর ও মন সতেজ হয়। কাজের প্রতি মনোযোগ ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। তাঁরা বলেন, দুপুরে ১০ থেকে ৪০ মিনিট ঘুমালে মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের ফলে রক্তে বেড়ে যাওয়া চাপ-হরমোনের stress hormones) মাত্রা কমে।
৬. ডান পাশ হয়ে ঘুমানো : মহানবী (সা.) ডান পাশ হয়ে ঘুমাতেন এবং অন্যদেরও ডান কাঁতে ঘুমাতে উৎসাহিত করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যখন বিছানায় যাবে, তখন নামাজের অজুর মতো অজু করে নেবে এবং তোমার ডান কাতে শোবে। অতঃপর বলবে...’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৭)
উপকার : ডান কাত হয়ে ঘুমালে হৃৎপিণ্ড ও পাকস্থলীর ওপর চাপ কমে, এসিড রিফ্লেক্স কমে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি ঘটে। তবে গর্ভবতী নারীর জন্য বাঁ কাত হয়ে ঘুমানো বেশি উপকারী।
৭. তেল ব্যবহার করা : মহানবী (সা.) চুলে ও শরীরে নিয়মিত তেল ব্যবহার করতেন। তিনি জয়তুন (অলিভ অয়েল) ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জয়তুন তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ কোরো। কেননা তা বরকতময় গাছ থেকে আসে।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস : ১৮৫১)
উপকার : ত্বক মসৃণ রাখে, চুলের পুষ্টি জোগায়, রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৮. বসে পান করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বসে পানাহার করতে বলেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০২৫)
উপকার : বসে পান করলে পানি ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করে। এতে শরীরের কোষগুলো ঠিকমতো পানি গ্রহণ করতে পারে এবং পানি অধিক পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে বের হয়ে যায়। বিপরীতে দাঁড়িয়ে পানি পান করলে কিডনি, পাকস্থলী ও শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৯. হাঁচির সময় মুখ ঢেকে রাখা : মহানবী (সা.) হাঁচির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখতেন।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন হাঁচি আসত তখন তিনি হাত বা কাপড় দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতেন এবং হাঁচির শব্দ নিচু করতেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০২৯)
উপকার : হাঁচির মাধ্যমে রোগ-জীবাণু ছড়ায়, যা করোনা মহামারির সময় ব্যাপকভাবে মানুষের সামনে এসেছে। তাই এই সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখলে অন্যরা ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে।
১০. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা : ইসলাম নির্ধারিত সময়ের বিরতিতে নখ কাটা, মোচ কাটা ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করার নির্দেশ দিয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয় মানুষের ফিতরাতের অন্তর্গত। খাতনা করা, নাভির নিম্নভাগের লোম চেঁছে ফেলা, গোঁফ ছাঁটা, নখ কাটা, বগলের পশম উপড়ে ফেলা।’
(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৯)
উপকার : ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ করে, ত্বক, চোখ, মুখ ও দেহের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন