যাত্রাশিল্প ধ্বংসের নেপথ্যে কারা
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি ও যাত্রাপালাকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ বলেন, বাংলাদেশে যাত্রাশিল্প খুবই গতিশীল ছিল একসময়। তবে আশির দশকে এসে এতে নাচের প্রবণতা বেড়ে গেল এবং একটা সময় এই নৃত্য অশালীনতার পর্যায়ে পৌঁছাল। আমরা মনে করেছিলাম, এই অশ্লীলতার কারণে যাত্রা দেখতে দর্শক কমে গেছে ও প্রশাসন অনুমতি দিচ্ছে না। কিন্তু এরপর একটি ঘটনা ঘটতে দেখে আমাদের বোধ হলো, যাত্রাপালার খরার জন্য শুধু অশ্লীলতাকে দায়ী করা যায় না। কারণ হঠাৎ করে ২০০১ সালে বেশ কটি যাত্রামঞ্চে বোমা হামলা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গের নেপমরদ মেলায় এই হামলা চালানো হয়। একসময় খোদ রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগে একটি যাত্রা প্যান্ডেলে দুজন নৃত্যশিল্পীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়। এতে যাত্রা মঞ্চায়ন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এবারের যাত্রা মৌসুমেও একই চিত্র বহাল রয়েছে। বর্তমানে দেশে দুই শতাধিক নিবন্ধনকৃত যাত্রাদল রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও পেশাদার যাত্রা মঞ্চায়নের খবর পাইনি। জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা মঞ্চায়নের অনুমতি দেয় না বলে যাত্রা মালিকদের এ ব্যাপারে আগ্রহ কমে গেছে। তবে বর্তমানে কিছু শৌখিন যাত্রাপালাকার দেশে কোথাও কোথাও যাত্রা মঞ্চায়ন করছে। আসলে দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন থেকে যাত্রার মৌসুম শুরু হলেও আসলে বর্ষাকালে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রা থেকেই যাত্রা শুরু হয়। এবার রথযাত্রার দিন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় দুটি যাত্রাদলের মহড়া হয়েছিল। একটি হচ্ছে অচিন্ত্য মহাজনের ‘শ্রীগুরু নাট্য সংস্থা’ আর অন্যটি কল্যাণী ঢালীর ‘মা প্রতিমা শ্রীকৃষষ্ণ... নাট্য সংস্থা’। অন্যদিকে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় শেফালি দাসের ‘প্রভাত অপেরা’ এবং একই এলাকার সমর মাস্টার আল্পনা বৈরাগীর একটি দলের মহড়া হয়। এ ছাড়া আমার জানামতে যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায়ও ছিল যাত্রার আনুষ্ঠানিকতা। পরবর্তীতে জানা যায়, বাগেরহাটের ব্রজেন নামের জনৈক যাত্রামালিক তার দলটির মহরত করেছিলেন। সর্বশেষ আমার কাছে থাকা তথ্যমতে, খুলনার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা থেকে কিছু পেশাদার যাত্রাশিল্পী (পুরুষ ও মহিলা) উত্তরবঙ্গের নাটোর ও পঞ্চগড়ে শৌখিন যাত্রাদলে অভিনয়ের জন্য বেশ কিছুদিন ধরে অপেক্ষা করছে। এদিকে গত পরশু জানতে পেরেছি নরসিংদী থেকে গীতিনাট্য যাত্রাদলের জনপ্রিয় নায়ক রতন একটি দল সাজিয়ে হবিগঞ্জে অপেক্ষা করছে। গতকাল থেকে তাদের পালা মঞ্চায়নের কথা ছিল। রাজবাড়ীর জঙ্গলে শ্রীগুরু নাট্য সংস্থার পালা মঞ্চায়ন শুরু হয় গত সোমবার থেকে। এদিকে ঢাকায় জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে গতকাল একটি যাত্রাপালা মঞ্চায়ন হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এর দল মালিক হলেন বরিশালের উজ্জ্বল। সার্বিকভাবে এবার আমরা যেটা আশঙ্কা করছি তা হলো- সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাতে করে খুব বেশি যাত্রাপালার মঞ্চায়ন করা যাবে না।
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা মিলনকান্তি দে বলেন, এবার দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সব সেক্টরই স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। যাত্রাপালাতেও তাই। যাত্রাপালা ধ্বংসের চেষ্টা কারা করছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মিলন কান্দি দে বলেন, সংস্কৃতিবিরোধী এক শ্রেণির অপশক্তি যাত্রাশিল্পকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে যাত্রা মঞ্চে ১৯৮১-৮২ সাল থেকে অশ্লীলতার আয়োজন করে।
মূলত এই অপশক্তিই যাত্রাশিল্প ধ্বংসের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, যাত্রাপালা মঞ্চায়নে দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলা একাডেমি ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিচ্ছে না। তাই যাত্রা মঞ্চায়নে সংশ্লিষ্টরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। এখন পেশাদাররা নয়, শৌখিন যাত্রাপালাকাররা কিছু যাত্রাপালার আয়োজন করছে। বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় টুকটাক যাত্রা মঞ্চায়ন করছে শৌখিন যাত্রাপালাকাররা।
অনুমতি দেওয়া হচ্ছে : শিল্পকলা একাডেমি
এদিকে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যাত্রাপালা মঞ্চায়নে আমরা অনুমতি দিই না এ কথা ঠিক নয়। তবে অশ্লীলতাসহ নানা অনৈতিক কারণে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন খবর পেয়ে অভিযুক্তদের যাত্রাপালা মঞ্চায়নের অনুমতি বাতিল করে থাকে। এ ছাড়াও যাত্রাপালাকাররা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেও যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করতে সক্ষম হন না বলে জানা গেছে।