‘হ্যাঁ ভাই, আপনার প্রিয় প্রেক্ষাগৃহে চলিতেছে... নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত চিরন্তন প্রেম ও পারিবারিক গল্পের ছবি ‘নাচের পুতুল’, অথবা ‘আসিতেছে বিউটি কুইন শাবানা অভিনীত নাচেগানে ভরপুর অ্যাকশন ছবি ‘নসীব’, কিংবা দুর্ধর্ষ খলনায়ক রাজীব আসছেন আপনার নিকটস্থ প্রেক্ষাগৃহে ‘ভাত দে’ নিয়ে’, ‘ঢাকাই ছবির হাসির রাজা টেলিসামাদ এবার নায়ক হয়ে আসছেন বড়পর্দায় ‘দিলদার আলী’ হয়ে।’ এভাবেই একসময় তারকার নামেই চলত ছবি। মানে ছবি দর্শকগ্রহণযোগ্যতার অন্যতম উপকরণ ছিল শিল্পী। এক্ষেত্রে শুধু নায়ক-নায়িকাই নন, খলনায়ক, কৌতুক অভিনেতা কিংবা শিশু শিল্পীর প্রতি দর্শক অনুরাগ ছিল প্রবল। এখন আর সেই অবস্থা নেই। বর্তমানে ঢাকাই ছবিতে একমাত্র শাকিব খান ছাড়া আর কোনো শিল্পী সিনেমা হলে দর্শক টানতে পারেন না। একসময় তারকারা ছিলেন দর্শকের আইকন-আইডল। তাদের মতো পোশাকআশাক, ফ্যাশন, হাঁটাচলার স্টাইল, কথা বলার ঢং অনুকরণ-অনুসরণ করতেন অনেকে। সিনেমায় দেখা চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নায়ক-নায়িকাদের নানা উপাধি-বিশেষণও দিতেন দর্শকরা। প্রিয় তারকার কোনো সংলাপও মুখে মুখে ফিরত। এ দেশের প্রথম বাংলা ছবি, ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। সেই ছবির প্রধান চরিত্র ডাকাতরূপী অভিনেতা ইনাম আহমেদের বলিষ্ঠ অভিনয়ের কারণে প্রথম ছবিই তাঁকে চলচ্চিত্রের স্থায়ী আসনে বসিয়ে দেয়। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে শবনম-রহমান জুটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছবিতে তাঁদের লিপসিং করা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’ এখনো দর্শকদের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে। এ ছবির পর শবনম-রহমান জুটি মানেই দর্শক ক্রেজ। তাঁদের অভিনীত চান্দা, তালাশ, হারানো দিন, দরশন এখনো জনপ্রিয় হয়ে আছে। ১৯৬৬ সালে রাজ্জাক-সুচন্দাকে জুটি করে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘বেহুলা’। ছবিটি এ দেশের চলচ্চিত্রে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এর নায়ক-নায়িকা হয়ে পড়েন দর্শক ভালোবাসার তারকা। তাঁদের ক্রেজ এমনই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করতে গেলে আগেই নিশ্চিত করে নিতেন সেই ছবিতে সুচন্দা-রাজ্জাক জুটি থাকবেন কি না। ১৯৬৭ সালে এহতেশাম তাঁর ‘চকোরী’ ছবির মাধ্যমে আরেক জনপ্রিয় জুটি নাদিম-শাবানাকে উপহার দিলেন। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান প্রযোজিত ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি হয়ে আছেন রাজ্জাক-ববিতা জুটি। এভাবে সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত বহু শিল্পীর নামেই ছবি চলত। তাঁদের নামের আগে দর্শক-ভক্তরা ভালোবেসে নানা বিশেষণও জুড়ে দিতেন। যেমন- নায়করাজ রাজ্জাক, ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা, মেগাস্টার উজ্জল, মিয়াভাই ফারুক, হ্যান্ডসাম হিরো আলমগীর, রাফ অ্যান্ড টাফ জসিম, লাভার বয় ও স্টাইলিশ জাফর ইকবাল, বাপ্পারাজ, হি-ম্যান হিরো ওয়াসিম, মহানায়ক বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, বিউটি কুইন শাবানা, মিষ্টি মেয়ে কবরী, ইন্টারন্যাশনাল ট্যালেন্ট ববিতা, ড্রিমগার্ল সুচরিতা, অঞ্জনা, অঞ্জু ঘোষ, অলিভিয়া, রোজিনা, দিতি, চম্পা, মমতাময়ী আনোয়ারা, রোজী সামাদ, রওশন জামিল, মুকুটবিহীন নবাব আনোয়ার হোসেন, খান আতা, কমেডি কিং টেলিসামাদ, আনিস, রবিউল, হাসমত, খান জয়নুল, সাইফুদ্দিন, মতি, দিলদার, খল অভিনেতা ফতেহ লোহানী, খলিল, মুস্তাফা, রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ। তাঁদের মতো কালজয়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী-শিল্পী তৈরি হচ্ছে না আর। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, বাংলাদেশের শাবানা-ই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি একটি দেশের চলচ্চিত্র জগতে সর্বকালের সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শাবানার কান্নায় কাঁদেননি এমন নারী দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না এ দেশে। ড্রিমগার্ল ববিতার জন্য তাঁর এক ভক্ত বুকেপিঠে নাম লিখে ১৯৮৩ সালে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন করেছিলেন। ১৯৯১ সালে এহতেশাম চলচ্চিত্রে আরেক জনপ্রিয় জুটি উপহার দেন। তাঁরা হলেন ‘শাবনাজ-নাঈম’। এই নির্মাতার ‘চাঁদনী’ ছবিতে অভিনয় করে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়ে যান তাঁরা। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে নায়ক করে আনেন সালমান শাহকে। অল্প সময়ের ক্যারিয়ারে দক্ষ অভিনয়গুণে এখনো তিনি হয়ে আছেন দেশীয় সিনেমার সাফল্যের বরপুত্র। ১৯৯৩ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত যেসব নায়ক-নায়িকা চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন গড়ে নেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- রিয়াজ, ফেরদৌস, শাবনূর, ওমর সানী, মৌসুমী, আমিন খান, মান্না, পপি, পূর্ণিমা, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, জয়া আহসান প্রমুখ। এ ছাড়া খল চরিত্রে মিশা সওদাগর ও শিশুশিল্পী হিসেবে দিঘী চলচ্চিত্রে স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নেন। এরপর চলচ্চিত্রে শুধু নায়ক-নায়িকা নন, অন্যান্য চরিত্রেও অনেক শিল্পী এসেছেন এবং আসছেন। সত্যিকার অর্থে তারা শুধু আসা-যাওয়ার মধ্যেই রয়েছেন। দর্শক হৃদয় বা চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছেন না। মানে এখন একমাত্র শাকিব খান ছাড়া আর কোনো তারকার নামে ছবি চলে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা বলেন, লিজেন্ডারি অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে গেলে সাধনার দরকার। এক্ষেত্রে নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের যৌথ প্রয়াস থাকতে হয়। এখন যারা আসছেন তাদের মধ্যে অল্প পরিশ্রমে দ্রুত তারকা এবং অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার লোভ বেশি। মেধাহীনতায় ভুগছে তারা। শূন্য থাকছে ফলাফল। নির্মাতারাও নতুনদের শিখিয়ে-পড়িয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারছেন না। নির্মাতারা যদি সঠিক নির্দেশনা দেন তাহলে হয়তো এই সংকট মোচন হতে পারে।