দশ তলায় থাকি। ওপরতলার বাসিন্দা হওয়ায় নিচের তিন দিকে যা ঘটে দেখতে পাই; শুনতে পাই প্রভাতি পাখির কিচিরমিচির আর মানুষের বক্তৃতা-ভাষণের বিচিত্র সব আওয়াজ। এক শুক্রবার দুপুরে শুনি ‘মসজিদের টাংকি মেরামত চলছে। পানি সরবরাহ স্থগিত আছে। মুসল্লি ভাইয়েরা যার যার বাড়িতে অজু করে জুমার নামাজে আসুন।’ মাইকে এই পরামর্শ দেওয়ার সাত/আট মিনিট পর বলা হয়- ‘একটি সুখ সংবাদ। দরাজ আলীর ভাতিজা ফরাজ আলী ইন্তেকাল হয়েছেন। জুমার পরে তাঁর জানাজা হবে।’
ঘোষকের উচ্চারণদোষে ‘শোক’ হয়ে গেছে ‘সুখ’। রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত যে ভবনে থেকেছি তার বাঁদিকের ফ্ল্যাটে আমার পড়শি রাইসুল বারিক। তিনি ঘোরতর সরকারবিরোধী নাগরিক। এক সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘বাই কবর পাইছেননি? মওদুদের হাতয় ফাওয়ার ছাড়ি দিয়া ব্যাডায় নাকি সৌদিতে ফলানোর ইস্খিম খরতেছে।’
বাই মানে ‘ভাই’। কবর মানে ‘খবর’। রাইসুল বারিকের কানে গুজব ঢুকেছে, উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদের হাতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে এইচ এম এরশাদ পালিয়ে সৌদি আরব যাওয়ার ইস্খিম (ফন্দি) করছেন। আমার এই পড়শিটি ন্যায়নিষ্ঠ, পরোপকারী এবং নিদ্রাবিদ্বেষী। তিনি বলতেন, চারদিকে যেসব অনাচার দিন দিন বেড়ে চলছে তার জন্য দায়ী বাঙালির নিদ্রামোহ। তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। জেগে ওঠা মানুষের অদম্য অভিযানে চুরমার হয়ে যাবে চণ্ড শক্তির দুর্গ।
বারিকের ভঙ্গিতেই এক বক্তা সেদিন মাইকে বক্তৃতা করছিলেন, চোখ বুজে আর চোখ খোলা রেখে আমরা নেতারা ঘুমাই আর ঘুমাই। নেতা মদন মজুমদারের কথাই ধরা যাক। লিডার মদন সকাল দশটায় বিছানা ছাড়েন, এগারোটায় নাশতা সারেন আর বারোটায় পাজামা-পাঞ্জাবি-কোটিতে সাজুগুজু হয়ে সমাবেশে বক্তৃতা দেন : জেগে ওঠো ভাই সকল। সব এলাকায় একজন দুজন মদন আছেন। মদনদের কাজ কী?
বক্তা নিজেই জবাব দেন। মদনদের কাজ হলো, নিজে যা করেন না বা করছেন না, তা করবার জন্য জনগণকে প্ররোচিত করা। তাঁরা বলেন, দুস্থজনকে অন্নদাও বস্ত্র দাও গৃহ দাও অর্থ দাও। দাও দাও দাও উচ্চারণে বড়ই মজা। দিব দিব দিব বলতে গেলে তাঁদের কলিজা ফুটো হয়ে রক্ত ঝরে। মদনদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, নয়বার কাতুকুতু দিয়ে আঠারোবার ঠ্যালা গুঁতো দেওয়া ছাড়া আপনারা ঘুম থেকে জেগে উঠতে অপারগ, অন্যকে জেগে উঠতে বলেন কোন্ আক্কেলে?
২.
কম সম্পদ, কম ঘুম, কম ঋণ, কম রোষ। এগুলো নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। হতেও পারে। তবে নিজের বেলায় করা নিরীক্ষণ বলছে, প্রথমটি কম থাকলে সমস্যা বেশি। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য
প্রয়োজনীয় প্রোটিনযুক্ত খাদ্য সংগ্রহ করতে গেলে টাকার পরিমাণ যথাযথ হওয়া চাই। ‘কম’ মানে কি যথাযথ?
প্রয়োজনীয় টাকা/সম্পদ কেমন করে অর্জন করি, এই ভাবনার ছোবল মাপা আট ঘণ্টাও ঘুমোতে দেয় না। কমপক্ষে ছয় থেকে আট ঘণ্টা না ঘুমোলে রক্তের ঊর্ধ্বচাপ ঘটে, মেজাজ হয় খিঁচখিচে এবং বেড়ে যায় ডায়াবেটিসে কবলিত হওয়ার ঝুঁকি। ঘুমের রয়েছে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক। যেমন- দেহ ঝরঝরে হওয়া, স্মৃতি ধারণের শক্তি বৃদ্ধি এবং বিষময় উপাদানগুলো দেহ থেকে বের করে নেওয়ার সহায়ক হরমন তেজোদীপ্তকরণ।
মাত্রাধিক নির্ঘুমের মতোই ক্ষতিকর মাত্রাধিক ঘুম। জেলখানার অভিজ্ঞ এক কর্মকর্তার মুখে শুনেছি, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া কয়েদির আধাপাকা চুল রায় ঘোষণার দিন সাতেকের মধ্যে পুরোপুরি পেকে যায়। মৃত্যুর গ্রাস এগিয়ে আসছে, এই চিন্তা তার ঘুম কেড়ে নেয়। নিদ্রাহীনতার প্রতিক্রিয়ায় শরীরের সেসব রসায়নকে অচল করে দেয়, যেসব রসায়ন চুলের স্বাভাবিকতা অটুট রাখার সহায়ক।
মজার ঘুমের জন্য নিরুদ্বেগ হওয়া অত্যাবশ্যক। দেখা যায়, কর্মব্যস্ত নগরের ব্যস্ততম সড়কের মাঝখানে থাকা আইল্যান্ডে ছিন্নমূল মানুষ ঘুমোচ্ছে। দুপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কত গাড়ি। গাড়ির শব্দ, ভেঁপুর শব্দ হচ্ছে। তবু ঘটছে না নিদ্রাসংহার। ছিন্নমূলের উদ্বেগ নেই বলে? না, তা নয়। অবশ্যই উদ্বেগ আছে। খুবই সীমিত সেটা। আজ তো খেলাম, কাল খাওয়ার পয়সা জোগাড়ে কোথায় মজুর হই, ব্যবস্থা একটা করে দাও হে মাবুদ। স্রষ্টার কাছে এই আবেদন জানাতে জানাতে সুখের নিদ্রায় নিজেকে সঁপে দেয় তারা।
সুখনিদ্রার এক সাধক ১৯৭৪ সালে আমার হৃদযন্ত্রের কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন প্রায়। সাধকের নাম গাজী লোকমান হোসেন। মেসবাড়িতে আমার রুমমেট নূরুল ইসলামের ‘লকু মামা’ তিনি। কুমিল্লার গ্রাম থেকে রাতে রওনা দিয়ে প্রত্যুষে রাজধানীতে তাঁর পদার্পণ। মেসবাড়িতে মানে চারতলা বাড়ির তেতলার একটি ফ্ল্যাট; এখানে আমরা পাঁচ বন্ধু বাস করি। চার বন্ধুর সকাল ন’টায় অফিসযাত্রা। আমার অফিস রাতের বেলায়। তাই দিনভর ঘরে থাকি। ভুট্টোর মা নামধেয় রাঁধুনি রোজ সকালে আমাদের জন্য রুটি-তরকারি বানিয়ে চলে যায় এবং ন’টার পর এসে ভাত-মাছ-ডাল পাকায়।
কেন জানি না সেদিন রুটি দিয়ে নাশতা না করে, মন চায় পরোটা-গোশত খেতে। মেসবাড়ির অদূরে বাজারের লাগোয়া রেলগেটের পাশে নামকরা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেলাম। ওদিকে রওনা দেওয়ার সময় দেখি, লকু মামা তাঁর ভাগনের খাটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাশতা সেরে ফিরে এসে দেখি মেসবাড়ির দোরগোড়ায় দশ-বারোজন লোক। তাদের সঙ্গে ভুট্টোর মা। সে জানায় বহুক্ষণ কড়ায় খটখটানো সত্ত্বেও সাড়া দিচ্ছেন না নূরুলের মামু। কৌতূহল মেটাতে জড়ো হওয়াদের একজন বলল, খাইছে! আপ্তহইত্তা দিছে না তো? আরেকজন বলেন, পুলিশে ফোন দেওন দরকার।
আত্মহত্যা করেছেন? হৃদযন্ত্রটা টন করে উঠল। শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল সবাই। কলরব করতে করতে জনতা ঢুকে পড়ে কামরায়। দেখা যায় বিছানায় ডান কাত হয়ে ঘুমের গভীর ভিতরে শায়িত গাজী লোকমান হোসেন। বহিরাগতদের মধ্যে থাকা ষণ্ডা চেহারার ব্যক্তিটি গাজীর কাঁধে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, মইরছেননি মিয়া? ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে বসে পড়েন লকু মামা। একবার মাত্র চোখ মেলে বলেন, ‘য়্যাঁ? কি অইছে- কি অইছে?’ ফের নিজের মাথাটা বালিশে এলিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তাঁর যাত্রা হলো শুরু।
৩.
‘মনোযোগ দিয়ে ঘুমানো এক শিল্পকর্ম।’ বলেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক জয়নাল আবেদিন (বছর খানেক আগে প্রয়াত)। জনু ভাই বলতেন, উপরঅলার ইশারা ছাড়া রহমতসদৃশ ঘুম অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে তিনি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ‘আসহাবে কাহ্ফ’ (গুহাবাসী সাথি) কাহিনি তুলে ধরেন। একেশ্বরবাদী সাত যুবককে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করছিল নিপীড়ক রোমান সম্রাট দেসিয়াসের লেলিয়ে দেওয়া সৈন্যরা। ছুটতে ছুটতে সাত সাথি ঢুকে পড়ে একটি গুহায়। তাদের সঙ্গে ছিল কিতমির নামের এক কুকুর। ক্লান্তদেহী যুবকরা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের পাহারা দেয় কিতমির।
ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তাদের খুব খিদে পায়। এক যুবক স্থানীয় বাজারে গেল কিছু খাবার কিনে আনতে। কেনাকাটার পর মূল্য বাবদ যে মুদ্রা দেয়, দোকানি তা দেখে বলে, এটা সম্রাট দেসিয়াস আমলের মুদ্রা! এত পুরোনো মুদ্রা তুমি কোথায় পেলে? এ মুদ্রা তো অচল। হিসাব কষে দেখা যায় যে দেসিয়াস মারা যাওয়ার ৩০৯ বছর পর সাত যুবকের ঘুম ভেঙেছিল। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসেও এক আল্লায় গভীরভাবে বিশ্বাসী সাত যুবকের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার বর্ণনা রয়েছে। ওই গুহা বর্তমান তুরস্কে ইফেসাস এলাকার সেলচুক নামক জায়গায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক গুহা দেখার জন্য প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভিড় করে।
চোখ বুঁজে অফিসের চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েন যারা- ধরা পড়লে তারা বলেন, সবই শুনতে পেয়েছি। চোখ বন্ধ রাখলেও কান খাড়া ছিল। অফিসে আসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের চোখ বোজা অবস্থায় যে ছবি ৭ নভেম্বর পত্রিকায় এসেছে, তা দেখে দুষ্টজনরা বলছেন, এনার তো হয়ে গেছে! একে দিয়ে কাজের কাজ কিস্সু হবার নয়। তবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র টেইলার রজার্স বলেন, প্রেসিডেন্ট ঘুমোচ্ছিলেন না।
ট্রাম্পের মতো ‘সৌভাগ্য’ রিগানের ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রীদের বাতচিৎ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তেন। তাঁর অফিসে বসে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার সমালোচনা করে পত্রিকায় লেখা হয়, ‘আমেরিকা এক জাগ্রত দেশ। তার ভাগ্যে জুটেছে এক ঘুমন্ত প্রেসিডেন্ট। ঈশ্বর দয়া কর। তাঁর নেতৃত্বে আমেরিকাকে ঘুমের জগতে নিয়ে যেও না প্রভু।’
উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন তাঁর ফুফা হায়ন ইয়ং চোলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। সুযোগ পেলেই চোল বলতেন, উন একটা গর্দভ। তাঁর উপদেষ্টারাও গর্দভ। গোয়েন্দারা ব্যাপারটি প্রেসিডেন্টকে জানায়। ফাজিল ফুফার দফারফার সুযোগ খুঁজতে থাকেন উন। সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে উনের উপস্থিতিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী চোল হালকা ঘুম দিচ্ছিলেন। এজন্য তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল প্রকাশ্যে বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় হায়ন ইয়ং চোলের দেহ গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছিল। বড় বড় অফিসে বড় বড় স্যারদের হালকাপাতলা ঘুমের পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা থাকে। মাঝারি সাইজের স্যারদেরও তো অফিসে ঘুমানোর সাধ জাগে। যাদের জাগে তাদের ভাগ্য যেন বান্নার মতো না হয়।
পাড়াতুতো বড় ভাই বান্না। তাঁর অফিসে এলেন পাড়াতুতো ছোট ভাই পান্না। তিনি বলেন, খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। শরীর খারাপ বান্না ভাই?
‘না রে সেটা নয়’ বলেন বান্না, ‘অফিসটা এক্কেরে মাছের বাজার হয়া গেছে রে পান্না। কোনো পরিবেশ নাই।’ পান্না বলেন, কিসের পরিবেশ নাই।
বান্নার উত্তর : ঘুমের।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন