মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের খবরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল করেছেন শহীদ ও আহতদের স্বজন এবং শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা আনন্দে মিষ্টি বিতরণ ও কোলাকুলি করেছেন। রায়ে সন্তুষ্ট হলেও সেটি কার্যকর হলেই মুখে হাসি ফুটবে বলে জানিয়েছেন শহীদদের স্বজনরা। গতকাল ট্রাইব্যুনালে রায়ের পর আনন্দ, উল্লাস ও প্রতিক্রিয়া জানান তারা।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ও আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই সুপ্রিম কোর্টের দক্ষিণ ফটকে উপস্থিত হন। রায় প্রদানকালে বিভিন্ন স্লোগানে তারা পুরো এলাকা মুখর করে রাখেন। শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের খবর প্রকাশ হতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থিত জনতা উল্লাসে মেতে ওঠেন। এ সময় ‘এ মুহূর্তে খবর এলো, শেখ হাসিনার ফাঁসি হলো’, ‘দড়ি লাগলে দড়ি নে, শেখ হাসিনার ফাঁসি দে’ স্লোগান দিতে থাকে জনতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এ সময় সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসিতে আনন্দ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মিষ্টি বিতরণ করেন। এদিকে রায় ঘোষণার খবর শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় পৌঁছানোর পর সেখানে শুরু হয় উল্লাস। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙতে যাওয়া ছাত্র-জনতা আনন্দ মিছিল বের করেন।
এদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় শহীদ মীর মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুজনের ফাঁসির রায়ে সাময়িক খুশি হলেও সন্তুষ্ট নই। শহীদ পরিবারগুলোর মুখে তখনই হাসি ফুটবে যখন এসব গণহত্যাকারীর ফাঁসিতে ঝুলতে দেখব।’
মোহাম্মদপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, ‘সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাজায় আমরা সন্তুষ্ট নই। তাকে ন্যূনতম যাবজ্জীবন সাজা দিতে হবে।’ শহীদ মিরাজের বাবা আবদুর রব বলেন, ‘আমরা কোনো ব্যক্তি নয়, পুরো ঘটনার বিচার চাই। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল সে সময় যেভাবে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সমর্থন ছাড়া এত বড় গণহত্যা সম্ভব ছিল না। আমরা চাই তাদেরও বিচার হোক।’
ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, ‘এই রায় যখন পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হবে তখনই প্রকৃত সন্তোষ প্রকাশ করতে পারব। সরকারের কাছে দাবি জানাই, অবিলম্বে যেন শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হয়।’ তিনি বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে জুলাই বিজয় ও শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের যে রায় হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট না।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, এই রায় শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি সারা পৃথিবীতে নজির স্থাপন করেছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই ‘মঞ্চ ২৪’ নামের ব্যানারে একদল ছাত্র-জনতাকে হাই কোর্টের সামনেই সেজদা ও মোনাজাতের মাধ্যমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়ার খবর পাঠিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।
রংপুর : শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে আনন্দ মিছিল, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে এসে দ্রুত বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন শহীদ আবু সাঈদের বাবা-মা ও সহপাঠীরা। সেই সঙ্গে গণ অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের মামলাগুলোরও দ্রুত বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন তারা। আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ফাঁসির রায় দেওয়ায় কিছু হলেও আমার অন্তরের কষ্ট প্রশমিত হলো। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে নিয়ে এসে অতি দ্রুত বাংলার মাটিতে তার ফাঁসি কার্যকর করা হোক। জীবদ্দশায় আমার ছেলের খুনির ফাঁসি যেন দেখে যেতে পারি।’ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। তাই আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। আজকে এ রায়ে আমরা অনেক খুশি।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে মিষ্টি বিতরণকালে শিক্ষার্থী শামসুর রহমান সুমন বলেন, ‘শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলন অন্যরকম রূপ নেয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় আমরা অনেক খুশি। এ রায় একটি নতুন ইতিহাস রচনা করল।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শওকাত আলী বলেন, ‘আবু সাঈদ হত্যা মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ আছে। সেটারও আমরা খুব দ্রুত রায় পাব। আবু সাঈদের রক্তের কাছে ঋণী হয়ে থাকব চিরকাল।’
চট্টগ্রাম : রায়কে স্বাগত জানিয়েছে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের দুই শহীদ পরিবার। শহীদ ওয়াসিম আকরামের বাবা শফি আলম বলেন, শুধু হাসিনা নয়, যারা হত্যা, হামলা ও নির্দেশনায় জড়িত ছিল, সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কহিনূর আক্তার বলেন, হাসিনাকে দেশে এনে যেন ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এই দাবি জানাই।
রাজশাহী : রায়ে রাজশাহীর পুঠিয়ায় আনন্দ মিছিল করেছে বিএনপি। বিকালে উপজেলা সদরে মিছিলটিতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল। নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে মিষ্টি বিতরণ করেছে এনসিপি।
বগুড়া : রায় ঘোষণার পরপরই জুলাই যোদ্ধারা আনন্দ মিছিল নিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় পথচারীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এনসিপি নেতা ডা. আবদুল্লাহ আল সানীসহ অন্য নেতারা মিছিলে অংশ নেন।
নোয়াখালী : রায়ে খুশি হয়ে নোয়াখালী জেলা কৃষক দলের উদ্যোগে মাইজদী বাজার এলাকায় আনন্দ মিছিল করেছেন নেতা-কর্মীরা। এতে জেলা কৃষক দলের সভাপতি ভিপি ফজলে এলাহি পলাশ, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কালাসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
গাজীপুর : রায় ঘোষণার পর গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানা বিএনপি আনন্দ মিছিল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে।
নারায়ণগঞ্জ : এনসিপির উদ্যোগে শহরের চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : রায়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও শিবিরের নেতারা মিষ্টি বিতরণ করেছেন।