আবশ্যকীয় পরিত্যাজ্য বদভ্যাসের একটি মাৎসর্য। আভিধানিক অর্থ পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা। আরেকটু এগোলে হিংসাবিদ্বেষকে বোঝায়। কথাটার সঙ্গে খানিকটা মিল রয়েছে হাংকিপাংকি শব্দের। শব্দটি খুব প্রচলিত না হলেও যারা জানেন তারা মনে করেন এর অর্থ হচ্ছে ছলচাতুরী। শব্দটির সাধারণ অর্থ করলে পরকীয়াও বলা হয়ে থাকে। গোপনে কিছু করা বা আঁতাতের অর্থে ব্যবহার করলে রাজনৈতিক ভাষায় এর অর্থ দাঁড়ায় তলেতলে খাতির। যাই বোঝাক না কেন এটি রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ার কারণে এর রাজনৈতিক অর্থ খোঁজাই বেহতের। এটি এমন এক সময় উচ্চারিত হয়েছে যখন দেশ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বোধ করি গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশ এতটা কঠিন বাস্তবতায় পৌঁছেনি। অভ্যন্তরীণভাবে আমরা যখন ঐকমত্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমঝোতায় উপনীত হতে ঘাম ছুটাচ্ছি তখন সীমান্তের অবস্থা খুবই নাজুক। খুব বড় করে কোথাও বলা না হলেও বাংলাদেশের একটি অংশ এখন প্রতিবেশীর করতলগত। অন্যদিকে প্রকাশ্যে নির্দলীয় সরকার বলা হলেও সরকারের বিরুদ্ধে দলীয় প্রভাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে উঠেছে। অবস্থা যখন এই তখন আমরা ঘি সোজা না বাঁকা আঙুলে তুলব তা নিয়ে সরগরম আলোচনায় ব্যস্ত।
প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ায় সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন বরিশাল জামায়াতের মনোনীত একজন প্রার্থী। অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, জুলাই বিপ্লবে নিহত মীর মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধ বিএনপিতে যোগদানের পর প্রশ্ন করা হয়েছে এটি কী কোটায় না মেধায়? অরেকটি বিষয় হচ্ছে, একজন ইউটিউবার তার ভেরিফায়েড পেজে ঘোষণা দিয়েছেন, বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর ব্যাপারে কোনো অভিযোগ গেলে আমাকে জানান। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ফ্যাসিবাদ নির্মূলে যখন আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ ও দৃঢ় হতে বদ্ধপরিকর তখন আমরা নিজেরাই যা করছি বা করতে যাচ্ছি বোধ করি তার কোনো উদাহরণ অতীত থেকে দেওয়া যাবে না। খুব কাছের উদাহরণ ’৭১ সাল থেকে বলি। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে গোটা জাতি যখন বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তখনকার অবস্থা বোঝাতে একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। ’৭৪ সালের দিকে ইরি ব্লকের একজন সরকারি পাম্প ড্রাইভারকে আনমনা দেখে লোকজন জানতে চাইল সে ঠিকমতো কাজ করছে না কেন? লোকটি নিঃশঙ্কচিত্তে জবাব দিল মুক্তিযুদ্ধে শান্তি কমিটিতে থাকার কারণে সে নিজ হাতে তার পিতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এখন সে পিতার শোকে পাথর। ভাবছে কেন করেছে। বাবার চিন্তায় তার সবকিছু বিগড়ে গেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শান্তি কমিটি বা অনুরূপ অপকর্মে থাকা নেতাদের সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছেন। স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট আওয়ামীদের ক্ষমতায়িত হওয়ার আগপর্যন্ত দেশে এ অবস্থা বিরাজমান ছিল। সামাজিক সম্পর্কে এসব প্রসঙ্গ অবান্তর ছিল। এমনকি বিগত দুই দুটি স্বৈরাচার মোকাবিলায় বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে। নির্বাচনও করেছে। গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে দুই দলে এমন কী ঘটেছে যে যেখানে ইসলামে ত্যাজ্যপুত্রের কোনো বিধান নেই সেই গর্হিত কাজটি করতে হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩ আগস্ট ’২৪ পর্যন্ত সারা দেশে ৮৭৫ জন শহীদ হয়েছেন। বিএনপির দাবি অনুযায়ী এর মধ্যে ৫২২ জন তাদের। বলেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির শহীদ হয়েছেন ১ হাজার ৫৫১ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৪২৩ জন। আসামি হয়েছেন ৬০ লাখ। এই বাস্তবতায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনালসের শিক্ষার্থী নিহত মীর মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুব হোসেন স্নিগ্ধ ঢাকার একটি আসনে বিএনপির হয়ে লড়বেন এ কথা শুনেই নানা বিষোদ্গার শুরু হয়েছে কেন? কোন শর্তে এটা বলা আছে যে জুলাই বিপ্লবে অংশ নেওয়াদের কেউ বিএনপি বা অন্য কোনো দল করতে পারবে না। কাজটি কারা করছে? এটা কার অজানা যে সাধারণভাবেই প্রার্থী করার বিবেচনায় জয়ী হওয়াটাকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নেওয়া হয়। তাহলে বিএনপির মনোনয়নের বিষয়টিকে মেধা কোটায় টেনে আনা মূলত প্রতিহিংসার প্রতিচ্ছবি। নির্বাচন করাকে কোটা না মেধা এই প্রশ্নে টেনে আনা হলেও জুলাই ঘোষণা নিয়েও সংগত আলোচনা উঠেছে। কেন ঘোষণা? থাক সে কথা, একজন ইউটিউবার বলেছেন বিএনপি প্রার্থীদের যত দোষ পাওয়া যায় তাকে লিখে জানান। উদ্দেশ্য তিনি বলেননি। বোঝা যায় তিনি সাবজেক্ট খুঁজছেন। রমরমা গল্প বলার। কিন্তু ব্যাপারটি বিএনপিকে নিয়ে কেন। যদি এমন হতো সব প্রার্থী নিয়ে তিনি বলছেন তাহলে অন্য কথা। এর সঙ্গে প্রতিহিংসার সম্পর্কে না মেলানোর কোনো কারণ আছে কি? বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর একটি বক্তব্যের দিকে চোখ ফেরানো যায়। তিনি সংস্কার ও জুলাই সনদ প্রসঙ্গে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। ইতোমধ্যে নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে বিবদমান বিষয়াবলি নিয়ে যে মাপা কথার বক্তব্য প্রদান করেছেন তার বিশ্লেষণ এখনো চলছে।
জুলাই বিপ্লবের পর দেশের রাজনৈতিক আবহে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ঠিক থাকলেও নতুন জোট বা জটলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে জামায়াতের নেতৃত্ব। প্রকাশিত খবর ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। জামায়াতও অভিনন্দন জানিয়েছে; তবে যদি ও কিন্তু রয়েছে। এখন তারা কোন পথে এগোবে। তার ওপর নির্ভর করবে তারা কী চায় তার স্বরূপ। বিষয়টি শুধু চলমান রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় তাহলে তার প্রকৃতি এক রকম দাঁড়াবে, যদি তা না হয়ে অন্য কিছু হয় তাহলে আন্দোলনের প্রকৃতি ভিন্ন রূপ নিতে বাধ্য। কারণ যারা খোঁজখবর রাখেন তাদের বক্তব্যে নানা দিক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন ঘিরে গণভোট বনাম জুলাই সনদের বিষয়টি নানাভাবে বিশ্লেষিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। উপদেষ্টার ভাষণ ও প্রেসিডেন্ট কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি ধারা অর্থাৎ চলমান পদ্ধতিই তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথাই বলা হয়েছে। দল ও জোটগুলো এটি মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সম্মতি দেওয়া। এ ক্ষেত্রে জামায়াত ও তাদের মিত্ররা ঠিক কোন পথ বেছে নেবে সেটি বুঝতে হয়তো আরও একটু সময় নেবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, জামায়াত ও মিত্ররা শেষমেশ চলমান ধারাতে প্রচলিত নির্বাচনে ব্যবস্থা মেনে নিয়েই রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখবে। যদি সেদিকে যায় তাহলে বলা যাবে নির্বাচনি ট্রেন কার্যতই স্টেশনে পৌঁছেছে। যদিও চরমোনাইয়ের পীর সাহেব মনে করেন পুরোনো বউকে নতুন কাপড়ে আনা হয়েছে। পুরোনো মদের জায়গায় তার নতুন শব্দচয়ন প্রশংসার তবে এ ক্ষেত্রে বউয়ের ব্যবহার যথাযথ কি না, সেটি বিচার্য। এসব বাদ দিয়ে বলা যায় একটি স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে থাকা জাতি হয়তো সে প্রত্যাশা পূরণের দিকেই এগোচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন হিংস না সহিংস হবে সেটি সময় নির্ধারণ করবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যাই বলুক নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো যথেষ্ট শক্ত অবস্থা সরকারের নেই। সে বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনীতি তো দেশের কল্যাণের জন্য। রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশ ও জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত করা। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ফ্যাসিবাদের কারণে জনগণের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দেশ মূলত পিছিয়ে গিয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা বা সৌহার্দ স্থাপনের বিষয়টি একবারেই ভিতরগত বিষয়। এটি ভালোবাসার মতো বিনে সুতার মালা। দেখে বা বলে বোঝানোর কোনো উপায় নেই। আমাদের রাজনৈতিক আবহে পারস্পরিক সুস্পর্কের ইতিহাস খুব একটা নেই। নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে গত সাড়ে ১৫ বছর দেশে কার্যত কোনো নির্বাচন হয়নি। আসন্ন নির্বাচনে সরকারি সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে নির্বাচন করতে না পারলেও তারা নির্বাচন করবে না, সে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়াও যারা নির্বাচন করছেন তাদের কথাতেও বারবার আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ আসছে। মাত্র সেদিন আঙুল বাঁকা করে ঘি তোলার কথা উঠল। এ নিয়ে এখন টিভির উপস্থাপক মোস্তফা কামাল স্বপন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপনকে খুব ছোট করে বললেন, কী বলবেন আপনি এ ব্যাপারে? জনাব রিপন আরও সহজ করে বললেন, আমরা দুজনই একসময় দুটি ছাত্রসংগঠনের প্রধান ছিলাম। আমাকে বলুক ঘি পাঠিয়ে দেব। এটি কথার কথা। ঘির মূল লক্ষ্য যদি ক্ষমতা বা ভিন্ন কোনো বিষয় হয়, তাহলে ক্ষমতা তুলতে আঙুল বাঁকা বলতে যদি সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝায় তাহলে সেটি প্রতিহিংসার পর্যায়ভুক্ত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুত্রের সঙ্গে পিতার আচরণে পরিবর্তন মূলত মাৎসর্য পর্যায়ভুক্ত। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দলমতনির্বিশেষে দেশের আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কম বেশি অনেকেরই অংশগ্রহণ রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছে। একে দলীয়করণ করা বা এ নিয়ে বাগাড়ম্বর সংগত নয় কাঙ্ক্ষিতও নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের দুর্গতি দেখে মরহুম আবুল মনসুর আহমদ মন্তব্য করছেন, বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা। আমরা অনেক মূল্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ হটিয়েছি। এখন নিজেদের প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জেদের ভাত বিশেষ প্রাণীকে খাওয়ানোর কোনো অর্থ হয় না। যখন একটি নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে তখন আসুন সব হীনম্মন্যতা পরিহার করে নির্বাচনকে উৎসব মনে করে অংশ নিই। হারজিতকে খেলার অংশ মনে করি। মনে রাখা দরকার এই খেলা খেলতে গিয়ে প্রতিহিংসার কারণে আবারও যদি কারও মায়ের বুক খালি করি, কোনো বোন বিধবা হয়, কোনো সন্তান পিতৃমাতৃহীন হয়, তাদের কান্নার রোল যদি আরশের মালিকের কাছে যায়, সে ক্ষতি কখনোই পূরণ হবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট