‘মানব গাড়ি তো আর চলে না রে’- শুধু একটি গানের লাইন নয়, যেন এক ক্লান্ত জীবনের আত্মস্বীকৃতি। কথাগুলো যখন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের মুখ থেকে বের হয়, তখন তা গানের সুরে বাঁধা মানেই নয়, তা হয়ে ওঠে সময়ের সাক্ষ্য। তিনি কেবল গায়ক নন, ছিলেন গীতিকার, সুরকার, দার্শনিক ও মানবতাবাদী এক কণ্ঠস্বর, যিনি বাউল গানের শেকড়কে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছিলেন। তিনি চলে গেলেও রেখে যান বিশুদ্ধ প্রেম, প্রতিবাদ আর মানবিকতার বার্তা বহনকারী পাঁচ শতাধিক গান। তাঁর গান যেন মানুষের ভিতরের কথাগুলোকেই সুরে বেঁধে বলা- যা শুনলে মনে হয়, ‘এই কথাগুলো তো আমারই!’ তাঁর প্রিয় শিষ্য আবদুর রহমান বয়াতির স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে এমন তিনটি গান, যেগুলোর পেছনে রয়েছে গভীর ভাবনার গল্প, জীবনের ছোঁয়া আর অন্তরের অনুরণন।
বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
এই গানটির জন্ম যেন এক আধ্যাত্মিক ধ্যানের ভিতর থেকে। নব্বইয়ের দশকে গভীর রাতে করিম বসে থাকতেন বেহালার সঙ্গেই। বলতেন, ‘গুরুকে না পেলে স্রষ্টাকেও পাওয়া যায় না।’ তিনি ছিলেন গুরুভক্ত মানুষ। তাঁর গুরু ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের পথপ্রদর্শক। একদিন এক অদ্ভুত নীরব মুহূর্তে গেয়ে ওঠেন, ‘কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে’। শিষ্য আবদুর রহমান বয়াতি তখন সঙ্গে ছিলেন, গানটি লিখে ফেলেন। গানে করিম শুধু প্রেম নয়, গুরুর প্রতি আত্মার আকর্ষণ, আত্মদানের এক নিবিড় আবেগ তুলে ধরেছেন। তবে বয়াতির আফসোস, অনেকেই গানটির অন্তরা ভুলভাবে গেয়ে থাকেন, যা গুরুজির মূল ভাবনাকে বিকৃত করে ফেলে।
গাড়ি চলে না
এ গানের জন্ম একেবারে করিমের অন্তরের কথাকে ঘিরে। তখন তিনি কিছুটা অসুস্থ, শারীরিকভাবে দুর্বল। বাড়ির পাশে কালনী নদীর পাড়ে বসেছিলেন একদিন, হাতে বেহালা। হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘মানব গাড়ি তো আর চলে না রে’। তিনি বুঝিয়েছিলেন, শুধু শরীর নয়, মন, আত্মা- সবই একরকম চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন গেয়ে ওঠেন। কিন্তু পুরো গান তিনি একদিনে লিখতেন না। কয়েক দিন পরপর কিছু লাইন করে তৈরি হয় গানটির। এমন অনেক গানই করিম এভাবে রচনা করতেন- সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠত গানের শরীর। তাই এ গান শুধু ক্লান্তি নয়, আত্মার আর্তনাদ, জীবনের ভারবাহী এক সুর।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
এ গানটি যেন একটি দীর্ঘশ্বাস, ফেলে আসা সময়ের প্রতি মমতা, হারিয়ে যাওয়া জীবনছন্দের প্রতি মায়া। আশির দশকের শুরুর দিকে, এক পালাগানের অনুষ্ঠানে দর্শকের হট্টগোলে পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। শাহ আবদুল করিম তখন মঞ্চে উঠে বলেছিলেন, ‘ওই, আপনেরা কি গান শুনবেন, না হট্টগোল করবেন?’ তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তায় হট্টগোল থেমে যায়, সবাই শান্ত হয়। গান শেষ করে যখন ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। সেই মুহূর্ত থেকেই গানটির বীজ বোনা হয়, যা পরে ফুলেফেঁপে ওঠে এক সর্বজনীন অনুভবে- সেই সরল সময়ের প্রতি স্মৃতিকাতরতায়। গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন, আন্তরিক সম্পর্ক আর নির্লোভ হৃদয়ের দিনগুলোর কথা যেন কান্নাভেজা কণ্ঠে ফিরে আসে এই গানে।
সুরের সাধক যিনি
শাহ আবদুল করিম আমাদের শুধু গান দিয়ে যাননি, দিয়ে গেছেন সময়, সমাজ আর আত্মার সংলাপ। তাঁর গানে আছে পিরিত, প্রতিবাদ, প্রেম ও দার্শনিকতা। তিনি ছিলেন বাউল, ছিলেন সুরের সাধক- যিনি গান দিয়ে বুঝিয়েছেন, জীবন কেবল শোনা বা দেখা নয়, উপলব্ধিরও বিষয়।