বাংলাদেশের নাটক শিল্পে দীর্ঘদিনের সংকট এক ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত এক বছরে নেমে এসেছে নজিরবিহীন স্থবিরতা। নির্মাণ কমেছে, প্রযোজনা বন্ধ, বিনিয়োগ অনুপস্থিত। এর ফলে শত শত অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী ও প্রযোজক চরম আর্থিক ও মানসিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, কেউ কেউ ইতোমধ্যে অভিনয় থেকে সরে গেছেন। শিল্পের এই অবনতিকে কেউ বলছেন ‘শিল্পহত্যা’, কেউবা ‘নীরব গণবেকারত্ব’। টিভি নাটকের পর্ব সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। বছরের প্রায় পুরোটা জুড়েই একক নাটক বা ধারাবাহিকের নির্মাণ হয়েছে গোনা গুটিকয়েক। বড় কোনো উৎসব ছাড়া নতুন নাটক আসছে না বললেই চলে। এমনকি বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এবং নিজস্ব উদ্যোগে করা ইউটিউব চ্যানেল, দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, যা একসময় নাটকের সম্ভাব্য আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হতো, সেখানেও কাজের গতি থেমে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মধ্যপর্যায়ের অভিনেত্রী জানান, ‘আগে অন্তত মাসে ২-৩টি নাটকে কাজ করতাম। এখন ৬-৭ মাসেও কেউ ডাকে না। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। ঘরভাড়া, স্কুলের ফি, বাজারের দাম-সবকিছুর চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। তাই অনেকে বিকল্প পথ খুঁজছেন।
প্রযোজনায় ভাটার টান, দায় কার?
নাট্যপ্রযোজক ও পরিচালকদের তথ্যমতে, কয়েকটি প্রধান কারণে প্রযোজনা কমে গেছে। তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনি চাপ, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন রাজস্ব হ্রাস, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতা, বিনিয়োগ অনীহা, রেভিনিউ আয়ের পথ সংকুচিত হওয়া। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মূল্যস্ফীতি নাট্য ও চলচ্চিত্রশিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। মিডিয়া হাউসগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে, বাজেট সংকোচন করছে। এর পাশাপাশি সামাজিক চাপও বেড়েছে। নির্মাতা সাজিন আহমেদ বাবুর মতে, ‘চ্যানেলগুলো এখন বাজেট দিতে চায় না, ইউটিউবে বিজ্ঞাপন আসে না, ওটিটিগুলোও কিছু তারকাকে ঘিরেই কাজ করছে। তাহলে বাকিরা কোথায় যাবে?’
নেই বাজেট, তবু তারকা শিল্পীর পারিশ্রমিক বেড়েছে কয়েকগুণ
নির্মাণ কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পারিশ্রমিকে। নাটকে কাজ না থাকায় শিল্পীরা এখন মাসের পর মাস উপার্জনহীন থাকছেন। বহু সিনিয়র শিল্পী জানাচ্ছেন, নিজের চিকিৎসা বা পরিবার চালানোর অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজেটের একটা বড় অংশ যায় প্রধান শিল্পীদের পারিশ্রমিকে। প্রথম সারির তারকাদের নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে গেলে সেই প্রোডাকশনের বাজেট লাগে ন্যূনতম ১৫-১৮ লাখ টাকা। অথচ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ২-৩ লাখের বেশি বাজেট দিতে চায় না। তবে বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভিউপ্রধান প্রথম সারির তারকার কাজই অবমুক্ত করতে চায় অধিক লাভের আশায়। এই সিন্ডিকেটের ফলে বাকি শিল্পীদের কাজ কমে গেছে অনেক। এই গরমিলেই যেন আটকে গেছে সবকিছু।
কারও কাজ আছে, কারও নেই
একদিকে কিছু পরিচিত মুখ নিয়মিত স্ক্রিনে হাজির, যাদের ঘিরেই যেন পুরো ইন্ডাস্ট্রির চাকা ঘোরে। অন্যদিকে অসংখ্য উদীয়মান, মধ্যম বা সিনিয়র শিল্পী অভিযোগ করছেন, ‘আমরা তো কাজই পাচ্ছি না’। তবে নির্মাতা বা প্রযোজকদের মতে, ‘কাজ না পাওয়ার দায় নির্মাতার নয়। শিল্পী যদি দর্শকের কাছে নিজের ভ্যালু তৈরি করতে না পারেন, নির্মাতা কীভাবে তাকে নিয়ে কাজ করবেন?’ এই বক্তব্য বাস্তবতা ছুঁয়ে গেলেও প্রশ্ন থেকে যায়, ভ্যালু তৈরি করার সুযোগই বা পাচ্ছেন কতজন?
বদলে গেছে দর্শক, বদলেছে অভ্যাস
বর্তমান সময়ের অন্যতম বাস্তবতা, দর্শকের রুচির পরিবর্তন। নাটকের দর্শক এখন মোবাইলে ব্যস্ত। মানুষের ধৈর্য কমে গেছে। শর্ট ভিডিও, রিলস, রিয়েল টাইম কনটেন্টে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তারা। দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। একটা ভালো নাটক যদি দর্শক গ্রহণই না করে, প্রযোজক কেন লগ্নি করবেন?’
ইউটিউব-ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আয় হ্রাস
একসময় ইউটিউব এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো নাটকের জন্য বিকল্প আশ্রয় ছিল। কিন্তু এখন সেখানেও চাহিদা কমেছে। ইউটিউব ও ফেসবুকের বিজ্ঞাপন আয়ের হার কমে যাওয়ায় প্রযোজকরা সাহস হারাচ্ছেন। যেসব তারকা নিজেদের ইউটিউবে নাটক অবমুক্ত করতেন নিয়মিত, তারাও কমিয়ে দিয়েছেন।
নাটকের জায়গা নিচ্ছে ওটিটি-সিনেমা
একসময় নাটকই ছিল তারকাদের প্রথম ধাপ। এখন অনেক জনপ্রিয় তারকাসহ কিছু ভিউখ্যাত শিল্পী নাটক ছেড়ে ছুটছেন ওটিটি ও সিনেমার দিকে। অনেকে বড়পর্দার স্বপ্নে নাটককে সাময়িক বিরতি দিয়েছেন। এর ফলে নাটকের জন্য নিবেদিত নতুন মুখ উঠে আসছে না। দেশীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপে কাজের সুযোগ থাকলেও, সেই জায়গাগুলোতে মূলত পরিচিত মুখ বা জনপ্রিয় তারকাদের নিয়েই কাজ হচ্ছে। তাই বাকি ৯৫% শিল্পীরা অবহেলিত হচ্ছে। এসব হতাশাগ্রস্ত শিল্পী তাই এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে আসছেন। কেউ কণ্ঠাভিনয় বা ভিন্ন কাজ দিয়ে মিডিয়াতে টিকে থাকারও চেষ্টা করছেন।
সিনিয়রদের অবহেলা
অনেক প্রযোজক এখন তরুণ শিল্পীদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, কারণ তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়। তাই সিনিয়র বা মাঝারি মানের অভিজ্ঞ শিল্পীরা উপেক্ষিত হচ্ছেন। ভিউ এর কারণে কিছু নবীন তারকা অভিনয় শিল্পীর পারিশ্রমিক বেড়েছে ১০ গুণ। কিন্তু সিনিয়র অভিনয় শিল্পীদের পারিশ্রমিক বেড়েছে কি? এমনকি তাদের চরিত্রের ব্যাপ্তিও কমে এসেছে। গল্পে তাদের চরিত্র রাখাকে প্রয়োজন মনে করছেন না অনেকেই। কিছু তরুণ অপেশাদার নাট্যনির্মাতা, প্রযোজক, অডিও প্রযোজনা সংস্থা, বিজ্ঞাপন এজেন্সি বা চ্যানেল মালিক সিনিয়র শিল্পীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন না।
সংকট থেকে সমাধানে রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সংস্কার জরুরি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও ভর্তুকি ঘোষণা নাটক নির্মাণে, নাটকের গল্প ও নির্মাণের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার সুরক্ষা, প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন, বিজ্ঞাপন খাতে কর রেয়াত ও ইনসেনটিভ, শিল্পীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও বেকার ভাতা প্রবর্তন, নতুন নির্মাতাদের জন্য স্টার্টআপ তহবিল।
নাটকে মা চরিত্রের অনেক অভিনয় করেছি। তবে বাজেট স্বল্পতা দেখিয়ে নির্মাতারা দিনে দিনে এই চরিত্র কাটছাঁট করছেন। তিন-চারজনকে নিয়ে নাটক বানাচ্ছেন। নির্মাতারা এখন একটি নাটক দুই-তিন দিনের মধ্যে শেষ করছেন, যেখানে সিনিয়র শিল্পীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। সম্মানি দিতে গেলেও সবাই টালবাহানা করে। মূল্যায়ন কমে গেছে। এখন আমাদের মতো সিনিয়রদের কাজ কমে যাচ্ছে। -দিলারা জামান
সিনিয়র শিল্পীদের চরিত্র একেবারেই যে থাকছে না তা কিন্তু নয়। আমি তো কাজ করছি এখনো। তবে সেটা সীমিত হয়ে গেছে। এর কারণ হতে পারে বাজেট সমস্যা। তা ছাড়া এখন দর্শক যা চাইছে তাই বানানো হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি তার গতিতেই চলছে। যখন যেখানে যা দরকার সেখানে তাই দেওয়া হচ্ছে। -তারিক আনাম
নাটকে চরিত্রের আধিক্য না থাকার কারণে আমাদের অনেক সিনিয়র শিল্পীই আজ বেকার। অনেকের কথা কী বলব আমি নিজেই সাফার করছি। কাজ নেই, প্রায় সময় বসে থাকতে হয়। এখনকার সময় সবাই নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। -শিরিন আলম
সামাজিক সেন্সরের কারণে নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে ব্যাপক সাবধানতা নিতে হচ্ছে। ফলে সৃজনশীলতা দমিয়ে রাখতে হচ্ছে। -সালাউদ্দিন লাভলু
প্রযোজকরা নিজেরাই পারিশ্রমিক বাড়িয়েছেন। এখন কেন শিল্পীদের দোষারোপ করছেন? নতুনদের নিয়ে কাজ তো করলেন না, বিকল্প গড়লেন না, এখন আবার শিল্পীদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন! -মৌসুমী হামিদ