দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের সঞ্চয় করার সামর্থ্য কমে গেছে। সুদহার নিয়ে ধূম্রজাল ও নিয়ম প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে সঞ্চয়পত্রেও আগের মতো আগ্রহ নেই। এর চেয়ে ব্যাংক ও সরকারি বিল-বন্ডে উচ্চ সুদের হার বিদ্যমান। সক্ষমতা কমাসহ এসব বিষয় বিবেচনায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সীমিত আগ্রহী থাকায় বিক্রি কমেছে। বরং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
জানা গেছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। পুরো অর্থবছরে নিট বিক্রি (বিনিয়োগ) ঋণাত্মক ছিল। এই সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি ছিল। এ নিয়ে টানা তিন অর্থবছর সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হলো। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে সরকারকে ঋণের জন্য ব্যাংক খাতের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হতে হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন অর্থবছর ধরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি টানা কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট বিক্রি কমেছে ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এতে সঞ্চয়পত্রে মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। আগের দুই অর্থবছরেও যথাক্রমে ২১ হাজার ১২৪ কোটি এবং তিন হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ কম হয়েছিল। সরকারের ঘাটতি বাজেট সামাল দেওয়ার নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল সঞ্চয়পত্র। দেশের মানুষেরও নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র ছিল এটি। কিন্তু এখন এদিকে নজর সরিয়ে দিয়েছে সরকার।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০১৯ সালে ‘জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালুর পর সঞ্চয়পত্র কেনার প্রক্রিয়া অনেক জটিল হয়েছে। একই নামে বড় অঙ্কে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ কমেছে। তা ছাড়া বড় অঙ্কের বিনিয়োগে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি ছয় মাস অন্তর সুদহার পরিবর্তনের নতুন নিয়মে সর্বশেষ জুলাই মাসে সুদহার ৪৭ থেকে ৫৭ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমেছে। বর্তমানে সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি ও কম বিনিয়োগে আলাদা সুদহার প্রযোজ্য হয়, যা অনেকের কাছে জটিল মনে হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের সুদহার দিন দিন বাড়ছে।
সঞ্চয়ের সীমিত ধারায় এখন বিনিয়োগকারীরা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। যেখানে ব্যাংক, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ফান্ড ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। ২০২৩ সালের জুন শেষে এই খাতে মোট বিনিয়োগ ছিল ২৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের জুন শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। গত দুই বছরে প্রায় পাঁচ গুণ বিনিয়োগ বেড়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে ট্রেজারি বিল-বন্ডে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এই সুবিধা করমুক্ত ও নিরাপদ। সময়মতো মুনাফা পাওয়ার নিশ্চয়তা ও সেকেন্ডারি বাজারে বিক্রির সুযোগ থাকায় এটি এখন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় খাতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমূল্যস্ফীতি থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গেছে। এ ছাড়া আমানত ও সরকারের বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ব্যাংক ও বিল-বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে নিট বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে। তবে সুদের হার বৃদ্ধি ও আয়কর রিটার্নমুক্ত বিক্রির সীমা বাড়ানোয় চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়বে বলে তাঁরা মনে করছেন।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দাখিলের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আগে এই সীমা ছিল পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে প্রতিষ্ঠান ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের সব সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা চালু করা হয়। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবের পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা আবার চালু করা হয়। ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগসীমা প্রত্যাহার করা হয়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গত জানুয়ারি থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে একটি সীমা পর্যন্ত সুদের হার বাড়িয়েছে সরকার। এসব উদ্যোগ সঞ্চয়পত্রে কিছুটা গতি আনতে পারে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজিম