প্রতিবেশী ভারত আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু, ৫৪ বছরে তার মীমাংসা হয়নি। সাধারণ ধারণাটা এমন যে একাত্তরে যারা অস্ত্রহাতে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তাদের বিবেচনায় ভারত বন্ধু। আর যারা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের হিসেবে শত্রু। এ ছাড়া যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তখন তারা নিজেদের সুবিধামতো সম্পর্ক তৈরি করেছেন। কেউ ভারতকে দাদা বলতে অজ্ঞান। কেউবা বলে দাদা নয়, ভারত আমাদের সঙ্গে দাদাগিরি করে। তিন দিক বেষ্টিত প্রতিবেশী বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারত সে সুযোগ নিয়ে নানান ছলে আমাদের সঙ্গে বরাবরই চাতুরী করেছে। কখনো নীতিতে করেছে, কখনো কূটনীতিতে। অবশ্য তারা যতটা না সুযোগ চেয়েছে, আমরা অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি দিয়েছি। প্রতিবেশী যে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠানামা হবে, এটাই স্বাভাবিক। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সব অপকর্মের প্রতি প্রতিবেশী দেশটির রাখঢাকহীন সমর্থন বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তাদের অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে ‘তাদের মানুষ’কে তারা নিরাপদে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে গেছে। প্রতিবেশীর অনেক বিনিয়োগ, আশাভরসা জুলাই বিপ্লবে ধুলোয় মিশে গেছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় দেশে আবার শুরু হয়েছে নতুন খেলা। ওপরে ওপরে ভারতবিরোধিতার কথা বলে ভিতরে ভিতরে ভারততোষণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যেভাবেই হোক ক্ষমতা চাই, এমন উদ্ভ্রান্ত মানসিকতায় নতুন মেরূকরণের খেলা চলছে পর্দার আড়ালে। ক্ষমতার জন্য দরকার ভারতপ্রেমীদের ভোট। বাক্স ভর্তি ভোট লাগবে, সে ভোট রহিমের হোক বা রামের। রহিমের ভোট হাতে রেখে রামের ভোটের জন্য দাদাদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাচ্ছে অনেকে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধও চাই, আবার ক্ষমতার জন্য তাদের ভোটও চাই। যদি তাই হয়, তাহলে জুলাই বিপ্লবের রক্তের ঋণ কীভাবে শোধ হবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব সব সময়ই ছিল, এখনো আছে। রাশিয়ার প্রভাবও ছিল অনেক দিন। চীনের প্রভাবও আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রভাব বরাবরই বেশি। ওয়ান-ইলেভেনের আগে অর্থাৎ ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে যারা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন, তাদের নাম বিভিন্ন কারণে সবাই জানেন। কারণ তাদের অনেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস জুনিয়র ২০০৩ সালের ২৭ মে থেকে ২০০৫ সালের ২ জুলাই, প্যাট্রিসিয়া এ. বুটেনিস ২০০৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন, জেমস এফ. মরিয়ার্টি ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ১৭ জুন, নিকোলাস ডিন (চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স) ২০১১ সালের ১৭ জুন থেকে ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর, ড্যান ডব্লিউ মোজেনা ২০১১ সালের ১৬ মে থেকে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি, মার্শা বার্নিকাট ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর, আর্ল আর মিলার ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি, পিটার ডি. হাস ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই, হেলেন লাফেভ (চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স) ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই থেকে ১ নভেম্বর, মেগান বোলডিন (চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স) ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ আছেন ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন (চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স)। একই সময়ে যারা ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন তারা হলেন বীণা সিক্রি ২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৬ সালের নভেম্বর, পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর, রজিত মিত্র ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের অক্টোবর, পঙ্কজ শরণ ২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর, হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি, রিভা গাঙ্গুলি দাস ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর, বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর এবং সর্বশেষ প্রণয় কুমার ভার্মা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস, প্যাট্রিসিয়া এ. বুটেনিস ও ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রি, পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা করে। সে পরিকল্পনায় সর্বাত্মক সহায়তা করে ভারত। আর আপত্তি জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণেই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দল ও সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নানান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও একজন উপমন্ত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নানান কটূক্তি, হাসিতামাশা করেন। ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে কটূক্তি করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে হাত পেতে বসে ছিলেন এবং মনে করেছিলেন নিশা দেশাই তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মোজেনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ করেন। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মোজেনার দূতিয়ালি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়দিন আগে উনি (খালেদা জিয়া) ছিলেন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে। মোজেনা তো কত চেষ্টা করলেন নির্বাচনটা বন্ধ করার জন্য। শেখ হাসিনা যাতে প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন তার জন্য। এমন কোনো চেষ্টা নেই যা তিনি করেননি। আল্লাহর ওয়াস্তে সবশেষে চাকরির মেয়াদও শেষ, ক্ষমতাও শেষ। আগামী সপ্তাহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবেন। জীবনে হয়তো আর বাংলাদেশে আসবেন না। বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নেই, “কাজের মেয়ে মর্জিনা” বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করবে।’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে বিএনপি ভেবেছিল কংগ্রেস গেছে, এবার ভারতের মোদি সরকার তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। মনে রাখতে হবে, মনমোহনের চেয়ে মোদি আরও কট্টরভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক।’ আওয়ামী লীগের ক্লিন ইমেজের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেমন সম্পর্ক তা প্রকাশ্যে স্পষ্ট হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের ওপর ঢাকার মোহাম্মদপুরে হামলা হয় এবং পিটার ডি. হাসকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষাৎই দেননি। একপর্যায়ে তাকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছে। জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিদায় নিয়েছিলেন। বিদায়ের সময় তিনি একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘এভাবে ঢাকা থেকে বিদায় নিতে হবে আমি আশা করিনি।’ অন্যদিকে ২০০৩ সাল থেকে ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারদের সখ্য ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগ দুর্বিনীত হয়ে যায় এবং বেপরোয়া গতির যানবাহনের মতো শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তা-ই হয়। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে ভারতের কাছেই ফিরে যান শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুধু যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হয়েছে তা নয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রতিবেশী ভারতের প্রতিও মানুষ অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। জুলাই বিপ্লবে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ফুঁসে ওঠার জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতই দায়ী।
জুলাই বিপ্লবে কোনো বিদেশি শক্তির ভূমিকা ছিল কি না তা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে যারা জানার তারা ঠিকই জানেন। অবশ্য জুলাই বিপ্লব চলাকালে ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কী হতে পারে সে সম্পর্কে মোজেনা বলেছিলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে। আবার পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। এটা হতেও পারে, না-ও হতে পারে।’ টাইম টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের তার এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন। সাক্ষাৎকারে মোজেনা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমি বহুদলীয় (রাজনৈতিক) প্রক্রিয়া সমর্থন করি। কয়েক দশক ধরে এখানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। এটা ভাঙা উচিত। এজন্য প্রয়োজন অর্থপূর্ণ সংস্কার। সীমান্তের কাছেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের ভিতরে পুনরেকত্রীকরণে নিজের স্বার্থেই সমর্থন করতে পারে ভারত। এমনও হতে পারে সহায়তা করতে পারে আন্তর্জাতিক বন্ধুরা। নৃশংসতার জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমর্থন আসতে পারে।’ মোজেনা ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই যা বলেছিলেন, এখন সেসবই দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো। অন্য দলগুলোও পুনরুজ্জীবিত হলো। সুতরাং এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে শুধু ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামল আর বিপ্লব হয়ে গেল।
বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম থেকেই অনেক খেলোয়াড় এটা নিয়ে খেলেছে। এখনো খেলছে। হয়তো ভবিষ্যতেও খেলবে। আমাদের নিয়ে খেলার সুযোগ আমরা নিজেরাই অন্যদের করে দিচ্ছি। অন্যরা আমাদের নিয়ে না খেললে আমাদের যেন ভালোই লাগে না। খেলারামরা আমাদের নিয়ে খেলতে চায়, আর তাদের সে সুযোগ দিয়ে আমরা শুধু ক্ষমতাটা চাই। জুলাই অভ্যুত্থানে একটি ফ্যাসিস্ট রিজমের পতন হলো ঠিকই; কিন্তু যাদের প্রশ্রয়ে ১৬ বছর বাংলাদেশের মানুষ বন্দিদশায় ছিল, নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গেই অনেকে আবার হাত মেলাতে চাচ্ছে। সবার টার্গেট এখন ক্ষমতা। গানের লিরিকে শব্দ মিলিয়ে বলতে হয়, ‘প্রথমত আমার ক্ষমতা চাই, দ্বিতীয়ত আমার ক্ষমতা চাই, শেষ পর্যন্ত আমার ক্ষমতা চাই।’ ক্ষমতার জন্য অনেকেই জনগণের ওপর ভরসা করতে পারছে না। রহিমের ভোট পকেটে আছে, এখন দরকার আওয়ামী লীগ ও রামের ভোট। প্রতিবেশীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুটি ভোটব্যাংক নিশ্চিত করতে পারলেই ক্ষমতা। এই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-সব নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাই যদি একমাত্র টার্গেট হবে, তাহলে আবু সাঈদরা রক্ত দিলেন কেন?
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন