রাজনৈতিক নেতার শিশুপুত্র পিতাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, রাজনীতি, রাষ্ট্র এসব বিষয় আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও।’ পিতা বললেন, ‘ওসব কঠিন বিষয় তুমি বুঝবে না বাবা। আগে বড় হও, তারপর বুঝবে।’ ত্যাঁদড় পুত্র বলল, ‘শিশুদের জন্য তো বড় বড় মানুষের জীবনী আছে, ছোটদের শেরেবাংলা, ছোটদের ভাসানী, ছোটদের বঙ্গবন্ধু। আমরা পড়ি। শিশুদের মতো করেই বুঝিয়ে দাও।’ পিতা পড়লেন মহাফাঁপড়ে। পুত্রের চাপে শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘মনে করো আমাদের এই সংসারটি একটি রাষ্ট্র। যেহেতু আমি এই রাষ্ট্রটি চালাই, তাই আমি সরকার।’ পুত্রের প্রশ্ন- আম্মু তাহলে কী? রাজনীতিক বললেন, ‘তোমার আম্মু যেহেতু আমার সব কথার বিরোধিতা করে, তাই সে হলো বিরোধী দল।’ পুত্র আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের কাজের মেয়ে জরিনা, আমার ছোট বোন টুসি, ওরা তাহলে কী?’ পিতা জবাব দিলেন, ‘জরিনা হলো জনগণ আর টুসি হলো জাতির ভবিষ্যৎ।’ নিজেকে দেখিয়ে পুত্র জিজ্ঞেস করল, আর আমি? পিতা বললেন, ধরো তুমি সাংবাদিক। পিতা-পুত্রের কথোপকথন এখানেই শেষ।
এর কয়েক দিন পর এক বিকালে ওই রাজনীতিক ঘুমাচ্ছিলেন। আর কোনো কারণে স্বামীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে কিছু বলছিলেন স্ত্রী। এর আগে কোনো একটি ভুলের জন্য কাজের মেয়ে জরিনা তার হাতে দুমদাম দু’চার ঘা খাওয়ার পর রান্নাঘরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আর ওদিকে সময়মতো দুধ খেতে না পেয়ে ছোট্ট খুকি টুসি গগনবিদারী চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলছিল। ঠিক ওই সময়েই ফোন করল রাজনীতিকের শ্যালক। ফোন ধরল তার ভাগনে। মামা তার ভাগনেকে জিজ্ঞেস করল, কী রে তোদের ফ্যামিলির খবর কী? ছেলেটি বলল, ‘মামা, সরকার ঘুমাচ্ছে, বিরোধী দল চিল্লাচ্ছে, জনগণ নির্যাতিত হয়ে কাঁদছে, জাতির ভবিষ্যৎ চিৎকার করছে। আর সাংবাদিক তোমাকে সব খবর জানিয়ে দিল।’ মামা বলল, ‘তাহলে তো তোদের ফ্যামিলির অবস্থা মারাত্মক। আচ্ছা আমি আসছি।’ ছেলেটির মামা ওদের বাসায় এসেছিল কি না বা এসে কী করেছিল গল্পে সেটা নেই। তবে গল্পের মতো পরিস্থিতি কিন্তু অনেক দেশেই মাঝেমধ্যে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়।
বস্তুত সরকার ঘুমালে একটি রাষ্ট্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি না হয়ে পারে না। তখন বিরোধী দল (যদি থাকে) যতই চিল্লাপাল্লা করুক, কোনো লাভ হয় না। কারণ সরকার কুম্ভকর্ণের মতো গভীর নিদ্রামগ্ন থাকায়, তার কর্ণকুহরে কিছুই প্রবেশ করে না। সে সময় অসহায় জনগণের ফুঁপিয়ে কাঁদা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তাদের অবস্থা হয় ‘না পারি সইতে, না পারি কইতে’। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাদের কথা শোনার মতো কেউ থাকে না। সরকার ঘুমিয়ে থাকায় শুনতে পায় না, আর বিরোধী দলের নিজেদের কথার আওয়াজে জনগণের কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এ গল্পটির উপমা অনেক সময় দিয়েছি। তাতে কেউ মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানিয়েছেন, কেউ আবার মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদীদের কথা ছিল, সরকার ঘুমায় এ কথাটিই ভুল। কেননা, সরকার ঘুমালে রাষ্ট্র চলে কী করে? তারা উদাহরণ দিতেন, ধরুন রাষ্ট্র একটি গাড়ি। আর সরকার তার ড্রাইভার। ড্রাইভার যদি ঘুমায় তাহলে গাড়ি তো রাস্তায় না থেকে খাদে গিয়ে পড়বে! তাদের বলতাম, গাড়ি কি সঠিক রাস্তায় আছে? দু-চারটি উদাহরণ দিলে তারা চুপ করে যেতেন। আসলে একটা সময় ছিল, যখন চারপাশের ঘটনাবলিতে বোঝা যেত না দেশে সরকার আছে কি নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ। পুলিশ-র্যাব ছিল শাসক দলের লাঠিয়াল বাহিনী। তারা যেটা বলত, সেটাই তামিল করত। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনত, আর বেঁধে আনতে বললে মারতে মারতে আনত। বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আদালত ছিল তাদেরই করায়ত্ত। অনাচার-অবিচারে দেশ হয়ে পড়েছিল মগের মুল্লুক। দেখার বা বলার কেউ ছিল না। শাসক দলের নেতা-পাতিনেতা, সিকি-আধুলি নেতাদের দাপটে সবাই ছিল থরহরিকম্প। সে সময়েও বিরোধী দল কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পেশিশক্তির সাঁড়াশি দিয়ে কণ্ঠ চেপে ধরায় আওয়াজ খুব একটা উঁচুতে উঠতে পারেনি। সরকার ও সরকারি দলের প্রচণ্ড চাপে দেশের সংবাদমাধ্যম তখন চুপসে ছিল। কিছু সংখ্যক আবার তেলবাজির তেলেসমাতি দেখাতে ছিল ব্যস্ত। সে সময় বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’-এর মতো পিলে চমকানো রিপোর্ট। রিপোর্ট পিলে চমকানো হলেও, ক্ষমতাসীনদের পিলে চমকেনি এতটুকু। তারা ‘অল দ্য বোগাস’ বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সত্যকে। কিন্তু ছাই দিয়ে যেমন জ¦লন্ত আগুনকে চাপা দেওয়া যায় না, তেমনি ক্ষমতার দাপটে সত্যকে বেশিদিন ঢেকে রাখা যায় না। গণ অসন্তোষ হলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। যে কোনো সময় তা লাভা উদ্গিরণ করে আশপাশের সবকিছু ভস্ম করে দিতে পারে। সেটাই ঘটেছে গত বছরের জুলাই আন্দোলনে। দীর্ঘ পনেরো বছরের দুঃশাসনে এ দেশের জনমনে ক্ষোভের যে আগ্নেয়গিরির জন্ম হয়েছিল, চব্বিশের ৫ আগস্ট তা লাভা উদ্গিরণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাজানো বাগানকে ভস্মীভূত করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বলা যায় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণ যদিও এ সরকার গঠনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না, তবু এটা ধরে নেওয়া যায়, ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্টই ছিল ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। দীর্ঘকাল বন্ধ থাকা দরজা খুলে দিলে একরাশ ঠান্ডা বাতাস যেমন মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়, তেমনি ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থান এ দেশের মানুষের মনে শান্তির শীতল পরশের অনুভূতি দিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, পক্ষপাতিত্ব নেই, তাই তারা দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জনগণের সে প্রত্যাশার বেলুন চুপসে গেল। গোটা দেশকে অস্থিরতা, অরাজকতা গ্রাস করল। কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী আর নবউত্থিত একটি সংগঠনের তরুণদের দর্পিত পদভারে কম্পিত হতে থাকল দেশ। কোথাও কোথাও দেখা গেল লীগ আমলের সেই জোর যার মুল্লুক তার নীতির বাস্তবায়ন।
জনগণের প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার হবে একটি জাগ্রত সরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঘুমের কাছে এরাও পরাস্ত। রাজধানী ঢাকা শুধু নয়, দেশের আনাচেকানাচে প্রতিদিন আত্মা কাঁপানো ঘটনা ঘটলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ঘুম ভাঙে না। তারা বোধহীন জড়বস্তুর ন্যায় নির্বিকার। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থবিরতার সুযোগে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের নর্তন কুর্দন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এরই মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আবির্ভূত হয় ‘মব’ নামের এক নয়া মুসিবত। অনাকাক্সিক্ষত সে ঘটনাগুলো আখ্যায়িত হতে থাকে ‘মব জাস্টিস’ বলে। অথচ ওইসব ঘটনায় জাস্টিস মানে ন্যায়বিচারের ছিটেফোঁটাও নেই। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সম্বিৎ ফেরে সবার। অভিহিত করা হতে থাকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা দলবদ্ধ সন্ত্রাস। এই দলবদ্ধ সন্ত্রাসের আগুনে পুড়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও। লুটপাট হয়েছে সম্পদ। সেসব কারখানা এখন বন্ধ। মালিকরা কেউ জেলে, কেউ পালিয়ে গেছেন বিদেশে। মাঝখান থেকে বেকার হয়েছে কয়েক লাখ সরাসরি ও সম্পর্কিত শ্রমজীবী মানুষ। লাভটা হলো কার বা কাদের তা আমরা হিসাব কষে দেখিনি। একটি সরকারের পতন হলে তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানার তৈরি করা দ্রব্যসামগ্রী, যন্ত্রাংশ, এমনকি ছাউনির টিন খুলে নেওয়া কী ধরনের ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যে কারখানাগুলো এখন বন্ধ রয়েছে, সেগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীরা কে কী অবস্থায় আছে আমরা খবর রাখি না। পাশাপাশি ওইসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য-ঘাটতি বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে নিশ্চয়ই। দুর্ভাগ্যজনক হলো, যে মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য ছিল অরাজকতা নিরসনের পদক্ষেপ নেওয়া, তখন তাদের দেখা গেছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকাতে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এক ধরনের অরাজকতা ঘিরে ধরে সমাজকে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, এর পেছনে মূল কারণ থাকে ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতা। বলাটা অত্যুক্তি হবে না, ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী অরাজকতার প্রধান কারণও তাই ছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, জনগণ বলতে শুরু করেছিল, তাহলে কি আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়লাম? এটা ঠিক যে, বিগত সাড়ে পনেরো বছর দেশে যে গণতন্ত্রহীনতা ও জবরদস্তিমূলক শাসন চলছিল, এখন তা নেই। তবে সবকিছু এখনো স্বাভাবিক হয়নি। যেমন- মব সন্ত্রাসের ইতি এখনো ঘটেনি। এখনো কোথাও মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও কবর থেকে তুলে একজন মুসলমানের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাও আবার রেখেঢেকে নয়, একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে। তাও পূর্বাহ্ণে মাইকে ঘোষণা দিয়ে। অথচ সেখানকার প্রশাসন অর্থাৎ সরকার ছিল নির্বিকার। তারা কিছুই করল না বা করতে পারল না। পরে ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’র মতো সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হলো, এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা সরকার বরদাশত করবে না। কৌতুককর বিষয় হলো, প্রতিটি মব সন্ত্রাসের পরই সরকার ‘আর বরদাশত করা হবে না’ বলে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে, আর একটার পর একটা ঘটনা ঘটতেই থাকে। এসব যে একটি সরকারের জেগে থাকার প্রমাণ বহন করে না, সে কথা পুনর্বার বলা নিষ্প্রয়োজন।
দেশে এখন আক্ষরিক অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। তাই সেই অর্থে তাদের চিল্লাপাল্লাও নেই। যারা আছে তারা সরকারের সমর্থক ও সহযোগী। তারপরও তারা সরকারবিরোধী দু-একটি কথা যে বলে না, তা নয়। তবে তা শুধুই নির্বাচন, অর্থাৎ তাদের ক্ষমতায় যাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে। জনগণের কথা সেখানে অবান্তর। আর জনগণ তো চিরকালই মরিচ, পাটাপুতার ঘষাঘষিতে যাদের জানের দফারফা হয়। আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। এ কথার সত্যতা যাচাই করতে হলে বাস-টেম্পোস্ট্যান্ড, মাছের আড়ত, রাজধানীর ফুটপাত কিংবা গ্রামগঞ্জের বাজারে যেতে হবে।
রচনার শুরুতে রাষ্ট্রের যে কল্পচিত্র বর্ণনা করেছি, আসলে তা রূপক। তবে একেবারে বাস্তবতাবিবর্জিত নয়। যে রাষ্ট্রের সরকার ঘুমিয়ে থাকে, সে রাষ্ট্র বা জাতির ভবিষ্যতের চিৎকার করে কাদা ছাড়া গত্যন্তর কী?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক