অবশেষে ট্রেনের হুইসল বাজবে বগুড়ায়, হবে রেলের জংশন, ঝিকঝিক শব্দে ছুটে চলবে রেল- সেই আনন্দে ভাসছে এখন বগুড়াবাসী। এখন বগুড়া থেকে কেউ রেলগাড়িতে করে ঢাকায় যেতে চাইলে নাটোর ও পাবনা জেলা হয়ে যেতে হয়, এতে অনেক সময় লাগে। ভাড়াও গুনতে হয় বেশি। পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলো বর্তমানে চলাচল করে নওগাঁর সান্তাহার, নাটোর ও পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জ হয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে। ফলে ট্রেনে বগুড়াবাসীর ঢাকা যেতে লাগে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। অথচ সড়কপথে বগুড়া থেকে ঢাকা পৌঁছাতে লাগে ৬ ঘণ্টা। নতুন রেলপথ চালু হলে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে মাত্র ৫ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব। তবে এজন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর। ২০২৬ সালে এ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। সব ঠিকমতো শেষ হলে ২০২৯ সালের শেষের দিকে ট্রেনে উঠতে পারবে বগুড়াবাসী।
জানা যায়, ২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার যাত্রীদের সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য সিরাজগঞ্জ জেলার জামতৈল ও বগুড়ার মধ্যে একটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংক সেই রেলপথ প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হওয়ার পর জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে একটি জরিপ করা হলেও রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিরোধিতার কারণে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় ঋণের অর্থে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয়ের অর্ধেক টাকা ভারত দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর দিচ্ছে না। ফলে বিকল্প পথে হাঁটছে সরকার।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল প্রকল্পের রেলপথ হলো ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রস্তাবিত ডুয়েলগেজ রেলপথ। এটি বাংলাদেশ সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত হবে। শুরুতে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগ এবং নকশা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিলম্বের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে। এ প্রকল্পের আওতায় ডুয়েলগেজের দুটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। একটি হলো-বগুড়ার ছোট বেলাইল এলাকা থেকে সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার এবং অপরটি বগুড়ার কাহালু স্টেশন থেকে রানীরহাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার। মূলত সান্তাহারের দিক থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে সান্তাহার হয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুরগামী ট্রেনগুলো যাতে বগুড়া স্টেশনকে এড়িয়ে সরাসরি চলাচল করতে পারে সেজন্য কাহালু-রানীরহাট রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুটি রেলপথ মিলিত হওয়ার কারণে বগুড়া শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে রানীরহাটে একটি জংশনও নির্মাণ করা হবে। আরেকটি জংশন হবে সিরাজগঞ্জে। নতুন রেলপথের জন্য দুই জেলায় আরও ছয়টি স্টেশন স্থাপন করা হবে। সেগুলো হলো শেরপুর, আড়িয়াবাজার, ছোনকা, চান্দাইকোনা, রায়গঞ্জ ও কৃষ্ণদিয়া। গত ১৬ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শফিউর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বগুড়া হতে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের অনুকূলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে মূলধন ব্যয় খাতের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ অর্থ অবমুক্ত করা হলো। বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি এম ইমরুল কায়েস জানান, বগুড়া অংশে ভূমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা চাহিদা ছিল। কিন্তু বরাদ্দ মিলেছে ৯৬০ কোটি টাকা। অবশেষে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হওয়ায় আনন্দে ভাসছে বগুড়াবাসী।
প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় ছয় বছর পর এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বগুড়া অংশে খরচ হবে ৯৬০ কোটি টাকা। এতে উচ্ছ্বসিত বগুড়ার মানুষ। জেলার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে জেগে উঠেছে খুশির আমেজ। বগুড়া জেলা প্রশাসন বলছে, আগামী অর্থবছরে কাজ শুরু হবে। আর শেষ হবে ২০২৯ সালের শেষের দিকে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হলে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার কমে উত্তরের অর্থনৈতিক গতি বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর উত্তরাঞ্চলবাসী। জানা গেছে, ৮৪ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ (ব্রডগেজ ও মিটারগেজ) নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য মোট ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। বগুড়া জেলার সীমানায় অধিগ্রহণ করা হবে ৪৭৯ দশমিক ১৫ একর। বাকি ৪২০ দশমিক ৬৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হবে সিরাজগঞ্জে। বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা জানান, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া অংশে খরচ হবে ৯৬০ কোটি টাকা। তিনি জানান, বর্তমানে জমি অধিগ্রহণে ৭ ধারার আপত্তি শুনানি চলছে। শুনানি শেষ হলে কে কত টাকা পাবেন সেটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর ৮ ধারার নোটিস জারি করা হবে। পর্যায়ক্রমে চেকের মাধ্যমে জমির মালিকদের টাকা পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া এ প্রকল্প দেরি হওয়ার কারণ হচ্ছে, ভারত অর্থ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর দিচ্ছে না। এজন্য সরকার এখন বিকল্প পথে হাঁটছে। এ ছাড়া টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি শেষ হয়েছে। দাতা সংস্থা চূড়ান্ত হলেই টেন্ডারের মাধ্যমে নির্মাণকাজ শুরু হবে। ২০২৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু হলে আশা করা যায় ২০২৯ সালের শেষের দিকে ট্রেনে উঠতে পারবে এ অঞ্চলের মানুষ।