দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজারে কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোহিঙ্গা কিশোরের সংখ্যা। সাগর পারের পর্যটন জোন কেন্দ্রিক এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা কিশোরের উৎপাত।
শুধুমাত্র শহরের কলাতলি গোলচত্বর (ডলফিন মোড়) স্টেশনেই অর্ধ শতাধিক রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরী অবস্থান নিয়ে থাকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দলে দলে এসব কিশোর-কিশোরী এসে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে।
শুধু রোহিঙ্গা নয়, রাজধানী ঢাকা থেকেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা পর্যটন শহরে এসে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব কিশোর অপরাধীরা এ শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকদেরকেই শিকার করার জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে থাকে। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় অন্তত শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান গত ২৫ জুলাই শুক্রবার বিকালে বলেন, ‘শহরে রোহিঙ্গা কিশোরের উৎপাত যেমনি তেমনি রয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে আসা কিশোর অপরাধীরাও। কয়েক দিন আগে কলাতলি গণপূর্ত পার্ক থেকে ১২ কিশোর অপরাধী আটক করি। তাদের মধ্যে ১০ জনই রোহিঙ্গা। আবার বৃহস্পতিবার রাতে আটক করা হয়েছে ঢাকা থেকে আসা ৪ কিশোর অপরাধীকে।’
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা কিশোরের দল সৈকত পাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে দলে দলে ভাগ হয়ে অপরাধে জড়িত থাকে। এক পয়েন্টের কিশোররা অন্য পয়েন্টে যায় না। কলাতলি গোলচত্বরে থাকা ৪০/৪৫ জন রোহিঙ্গা কিশোর ঘুরে ফিরেই একই স্থানে থাকে। কক্সবাজারের সঙ্গে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকে কক্সবাজারমুখি ঢাকার কিশোর গ্যায়ের সদস্যদের আনাগোনা বেড়ে গেছে।
থানার ওসি আরো জানান, গত ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার শহরের ঝাউতলা এলাকার রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড পরিদর্শনে এসে সেনাবাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা দম্পতির কাছ থেকে মোবাইল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরে পুলিশ অভিযানে নেমে রাতেই সেই খোয়া যাওয়া ব্যাগসহ ৪ জন কিশোর অপরাধীকে আটক করে। আটক হওয়া ৪ জনই রাজধানী ঢাকা থেকে এসে কক্সবাজার শহরে ছিনতাই কাজে নামে। ঢাকা থেকে গত ৫ আগস্টের পর কক্সবাজারে আসা কিশোর অপরাধী দলের একজন হচ্ছে রুবেল।
রুবেল জানায়, তারা ৪ জনই ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে কাজ করে আসছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তারা কক্সবাজার আসে। ইতিমধ্যে তাদের তিনজন যথাক্রমে মীর, ফয়সাল ও রাকিব আবার ঢাকায় ফিরে গেছে বলেও জানায় রুবেল। রুবেল অসুস্থ থাকায় সে কক্সবাজারে তার দলের সঙ্গে অবস্থান করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অবাধে আসা-যাওয়া করে থাকে কিশোর-কিশোরীর দল। অনেকেই আছে সকালে কক্সবাজার শহরে আসে আবার রাতে ক্যাম্পে ফিরে যায়। তবে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীরা রাতের বেলায় গোলচত্বর এলাকার পুলিশ বক্সসহ হোটেল-রেস্তোরাঁর বারান্দায় ঘুমিয়ে রাত কাটায়।
রোহিঙ্গারা নিজেরাই যেমনি গ্যাং (দলবদ্ধ) বেঁধে থাকে তেমনি আবার স্থানীয়দের সঙ্গেও শেয়ারে অপরাধজনক কাজে জড়িত থাকে। শহরের কলাতলি গোলচত্বর এলাকায় রোহিঙ্গা কিশোরদের সঙ্গে রয়েছে রোহিঙ্গা কিশোরীরাও। রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীর দল প্রায় সবাই মাদকাসক্ত থাকে। তারা কলাতলি স্কুলের পার্শ্ববর্তী টায়ার-টিউব বিক্রির একটি দোকান থেকে সলিউশন (গাম) কিনে নিয়ে নেশা করে থাকে।
মোতাহের হোসেন নামের একজন রোহিঙ্গা কিশোর শুক্রবার জানান, ‘কলাতলি গোলচত্বর স্টেশনের রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীরা সবাই মাদকাসক্ত। তারা গাড়ির টায়ার-টিউব এবং জুতা সেলাইয়ের কাজে ব্যবহার করা সলিউশন (গাম) নিয়ে নেশা করে।’
মোতাহের জানায়, প্রতি কৌটা সলিউশন ৮০/১০০ টাকায় কিনে ৪/৫ জনে বসে পলিথিনের সাহায্যে ঘ্রাণ নিয়ে নেশা করে থাকে। গাম সস্তায় পাওয়া যায় বিধায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এটাই বেশি ব্যবহার করে থাকে নেশার জন্য।
মোতাহের এবং তার সঙ্গীরাও এক সময় গাম নিয়ে নেশায় অভ্যস্ত ছিল জানিয়ে আরো জানায়, শহরে পথশিশুদের (ছিন্নমুল) নিয়ে কাজ করা ‘নতুন জীবন’ সংগটনের পরিচালক স্থানীয় সংবাদকর্মী ওমর ফারুক হিরুর সহযোগিতায় তারা মাদক ছেড়েছে।
ওমর ফারুক হিরু বলেন, তিনি গত এক দশক সময় ধরে শহরের পথশিশুদের নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রসহ নানা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে তিনি পথশিশুদের মাদকাসক্ত থেকে অনেক শিশুকে ফিরিয়ে এনেছেন।
তরুণ সাংবাদিক ওমর ফারুক হিরু জানান, ‘এসব ছিন্নমূল প্রতিজন শিশুদের জীবনগাঁথায় রয়েছে অনেক বিষাদের গল্প। তারা অপরাধী নয়। তাদের অপরাধী বানায় সমাজের কিছু অমানুষ।’
এ প্রসেঙ্গ নিজের অভিজ্ঞতায় বলেন, খাইরুল আমিন বোতল নামের একজন কিশোরকে দিয়ে এ শহরের মাদক কারবারি ও মাদকসেবীদের মাদক পরিবহনে বাধ্য করে। কিশোর দীর্ঘদিন ধরে মাদক বহন করতে করতে সে এখন বড় মাপের একজন মাদকসেবী হয়ে উঠেছে। তেমনি আবদুল্লাহ নামের এক কিশোরকে নানা শ্রেণির লোকজন পতিতা আনার কাজে লাগাতে গিয়ে সেই কিশোর নিজেও বিয়ে করেছে পতিতা। আবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাদকাসক্ত। মাদকের জন্য আবদুল্লাহ অনেক বড় ধরনের অপরাধও ইতিমধ্যে সংঘটিত করেছে বলে জানান ওমর ফারুক হিরু।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাগর পারেই সবচেয়ে বেশি তৎপর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গোলচত্বর এলাকাটি সৈকত শহরের গেটওয়ে হিসাবে পরিচিত। দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসগুলো যাত্রী নামিয়ে দেয় এখানেই। আবার অনেক গাড়ির টিকিট কাউন্টারও এখানে। এ কারণে গোলচত্বর স্টেশনটি ভ্রমণকারী পর্যটকদের নিয়ে সবসময় জমজমাট অবস্থায় থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাই স্টেশনটিতে ঘুর ঘুর করে থাকে বেশির ভাগ সময়।
সাগর পারের সুগন্ধা পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট, সীগাল পয়েন্ট, কবিতা চত্বর, ডিভাইন পয়েন্টসহ সৈকতের নির্জন এলাকাগুলোতে তারা ওঁৎ পেতে থাকে। সৈকত ভ্রমণকারীদের মাদক এবং পতিতা সরবরাহ দিতে গিয়ে এসব কিশোরের দল নানা কৌশলে তাদের ফাঁদে ফেলে কেড়ে নেয় সর্বস্ব।
কক্সবাজারের কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, গেল কয়েক মাসে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অন্তত ২৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জানান, গত ১৬ জুলাই শহরের নুনিয়াছড়া এলাকায় মোবাইল ছিনতাইকালে তিন কিশোর গ্যাং সদস্যকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজিম