শরীফুল ইসলামের কাছে তার পার্শ্ববর্তী পরিচিত এক ব্যক্তি ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেন। তিনি লেখেন- আমার কিছু টাকা লাগবে। এখন দেওয়া যাবে? আমি সন্ধ্যার সময় দিয়ে দেব। শরীফ লেখেন- কত টাকা লাগবে? ওই ব্যক্তি লেখেন, ২৫ হাজার টাকা। পরে তিনি একটি বিকাশ নম্বর দেন। আর ওই নম্বরে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন শরীফ। এরপর পরিচিত ওয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন দিলেও রেন্সপন্স পাচ্ছিলেন না, কিন্তু ওয়াটসঅ্যাপ অ্যাকটিভ দেখাচ্ছিল। পরে শরীফ পরিচিত ওই ব্যক্তির আরেকটি নম্বরে ফোন দিয়ে জানতে পারেন, তার ওয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। এস এম মসিহ রানার (S M Moseeh Rana) কাছে এক ব্যক্তি ফোন করে নিজেকে সিএমএইচ-এ চাকরি করেন পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনি কি করোনা টিকার স্মার্ট কার্ড পেয়েছেন? জবাবে, মসিহ রানা বলেন, না। ওই ব্যক্তি বলেন, আপনার মোবাইল ফোনে একটা কোড নম্বর যাবে, ওই কোড নম্বরটি আমাকে জানান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মসিহ রানার মোবাইল ফোনে একটি কোড নম্বর আসে। সঙ্গে সঙ্গেই ওই ব্যক্তি আবারও ফোন করেন। কোড নম্বরটি জানতে চায়। মসিহ রানা কোড নম্বরটি বলে দেন। এরপর ওই ব্যক্তি বলেন, আমি একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি, আগামীকাল ওই নম্বরে ফোন দিলেই আপনার স্মার্ট কার্ডটি পেয়ে যাবেন। এরপরই মসিহ রানার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার অ্যাকাউন্ট হ্যাকারদের দখলে চলে যায়। এস এম মসিহ রানার পরিচিত সবার কাছে ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দাবি করে হ্যাকার চক্রটি।
সামছুল হক একজন প্রবাসী। তার বোনের কাছে সামছুল হকের ইমো আইডি থেকে একটি ভয়েস ম্যাসেজ আসে। ভয়েস ম্যাসেজটি হুবহু সামছুল হকের কণ্ঠের মতো ছিল। ভয়েস ম্যাসেজে বলা হয়, সামছুল হক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, তিনি অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে টাকা পাঠাতে হবে। ভয়েস ম্যাসেজটি শোনার পর তার পরিবার ভয়েস ম্যাসেজে দেওয়া নম্বরে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬ লাখ টাকা পাঠান। টাকা পাঠানোর দুই দিন পর পরিবারের লোকজন সামছুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, সামছুল হকের ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। এ কয়েকটি ঘটনা মাত্র। এভাবে প্রতিনিয়ত ওয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে হ্যাকারদের থাবা।
অনেককে করা হচ্ছে ব্লাকমেল, আবার অনেকের আইডি ব্যবহার করে তার স্বজনদের বিভিন্ন প্রলোভন কিংবা দুঃসংবাদ দিয়েও টাকা হাতানো হচ্ছে। আর এ কাজে প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতন নয় অথবা অল্পতে সরল বিশ্বাস করা লোকরাই বিপদে পড়ছেন বেশি। এটি এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, অনেকে হ্যাকিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আবার অন্য কারও আইডি হ্যাক করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়ে সফলও হচ্ছেন। নিমিষেই এসব প্রতারক বাড়ি-গাড়ির মালিক হচ্ছেন। যতগুলো আইডি নিয়মিত হ্যাক হচ্ছে, সে অনুযায়ী হ্যাকারদের চিহ্নিত করা বা গ্রেপ্তারের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিশিং লিংক ব্যবহার করে প্রতারকরা বেশি আইডি হ্যাক করে থাকে। এ কাজে টার্গেটেড ব্যক্তিদের আকর্ষণীয় বা লোভনীয় কোনো লিংকে ক্লিক করার জন্য বলে হ্যাকার। সেখানে ক্লিক করা হলেই সেসব অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য হ্যাকারদের কাছে চলে যায়। পরে এ লিংকে ক্লিক করলে ফেসবুক ইন্টারফেস আসে। তখন সেই লিংকে ঢুকতে ফেসবুক আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিলে আইডির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হ্যাকারের কাছে। এ ছাড়া ফোন করে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে কোড বা ওটিপি হাতিয়ে নেওয়া, ইমেইল বা ফোন নম্বর বা জন্ম তারিখের মতো বিষয়গুলো পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা, ফোন বা ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়া, মেরামতের সময় তথ্য নেওয়া, ফ্রি ওয়াইফাই এলাকায় ব্রাউজারে প্রবেশ করে পাসওয়ার্ড দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের কাছ থেকেও প্রতারকরা নম্বর নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন পরিচয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে ওটিপি সংগ্রহ করে নেয়। পরে ওয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অপরাধ কর্মকা করছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার-দক্ষিণ) সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতারকরা কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কখনো বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। সহজ-সরল মানুষ তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে। প্রতিদিনই আমরা এ ধরনের প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। কখনো অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত ওয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার বা ইমো নম্বর, পাসওয়ার্ড অথবা ওটিপি শেয়ার করা যাবে না। সবাইকে এ ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সাইবার স্পেসে অপরিচিত কোনো আইডি থেকে পাঠানো কোনো লিংকে প্রবেশ না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিচিত কোনো আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথাযথ সিকিউরিটি সেটিংস ব্যবহার করা, ওয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার বা ইমোতে স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি বা ভিডিও শেয়ার না করা- এসব বিষয়ে একটু সচেতন হলেই সাইবার অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। আর কেউ যদি এসব প্রতারণার ফাঁদে পড়েই যান তবে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ থানা কিংবা ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।