তিন দিন আগে জ্বর আসে সাত বছরের মেয়ের, এরপর আক্রান্ত হন বীথি সরকার (৩২)। বুধবার টেস্ট করলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় তার। গতকাল ভোরে মারা যান বীথি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের পটুয়াখালী প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার দাসের স্ত্রী। সঞ্জয় দাস বলেন, প্রথমে বীথিকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তার রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ায় আইসিইউতে নিতে হবে জানান চিকিৎসকরা। রাতে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। গতকাল ভোরে মারা যান বীথি। দুই মেয়েকে নিয়ে আমাদের সাজানো সংসার ধ্বংস করে দিল ডেঙ্গু।
দেশে ডেঙ্গুর থাবায় এর মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন ১০৮ জন, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৫৭৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ হিসাবের বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগী। এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ বছর চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী থেকে সারা দেশে। এর সঙ্গে মৌসুমি জ্বর, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। টেস্ট করলে শনাক্ত হচ্ছে করোনাও। জ্বর, সর্দি, কাশিতে নাজেহাল অবস্থা। দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে জ্বর নিয়ে ভুগছে মানুষ। তাই জ্বর এলে দেরি না করে দ্রুত ডেঙ্গু টেস্ট করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কারণ ডেঙ্গু রোগীদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হাসপাতালে দেরিতে ভর্তি হওয়াকে দায়ী করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ রোগী হাসপাতালে দেরি করে এসেছিলেন। যখন রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। হাসপাতালে এলে আমরা মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার সময় পাচ্ছি। তাই জ্বর এলে ডেঙ্গু শনাক্তে টেস্ট করাতে হবে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে এবং হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর চিকুনগুনিয়াতেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার জন্য কিট সরবরাহ করা হয়েছে। কোনো হাসপাতাল সংকটের কথা জানালে সেখানে সঙ্গে সঙ্গে কিট পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২৫ হাজার ৫৭৬ জন রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৯৬৫ জন। বরিশাল বিভাগে এ বছর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু বরগুনা জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৩৬০ জন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এ জেলার ১২ জন রোগী। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ ম ল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এসব বিষয় মানা হয় না। শেষ মুহূর্তে নিয়ে আসেন। তখন চিকিৎসকরা অসহায় হয়ে পড়েন। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু মেনে নিতে হয়।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম এ তথ্য জানিয়েছেন। আইইডিসিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে কিছু রোগী পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই বছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৌসুমি, জ্বর, নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগ, ক্লিনিক, চিকিৎসকদের চেম্বারে ভিড় করছেন রোগীরা। শ্বাসকষ্টের তীব্রতায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে অনেক রোগীকে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বছর জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, শাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ নিয়ে অনেক রোগী আমাদের কাছে আসছেন। জ্বর আসলে অবশ্যই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে। নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নেগেটিভ হলেও অনেকের জ্বর, কাশি হচ্ছে। তাদের অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে এবং বাড়িতে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকা ভালো।’
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে দাপট দেখাচ্ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। প্রতিদিনই শনাক্ত হচ্ছে রোগ দুটি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছেন। চলতি আগস্টের ১৩ দিনে চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন ৯১৭ জন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৭০ জন।
কক্সবাজার : সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৩৪ জন। যার মধ্যে ৪ হাজার ১৮২ জনই রোহিঙ্গা, আর স্থানীয় ৭৫২ জন। শুধু জুলাই মাসেই আক্রান্ত ১ হাজার ৫৯৫ জন। এর মধ্যে স্থানীয় ৩১৩ জন ও ১ হাজার ২৮২ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
যশোর : বুধবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেলায় ১০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই সময়ের আগে আক্রান্ত হওয়া তিনজন রোগী সুস্থ হয়েছেন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এখনো ভর্তি আছেন ২২ জন।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় চারজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। সুস্থ হওয়ায় একই সময়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে সাতজনকে। গতকাল বিকালে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
রাজশাহী : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কখনো বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গেল ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনজন রোগী। হাসপাতালটিতে আগের রোগী আছে ১০ জন।
রাজবাড়ী : গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুজন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ আবদুল হান্নান।