পার্বত্যাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা পাকানোর ট্রায়াল রান আবারও। খেলাটি পুরনো, খেলোয়াড় বদলানো হয় মাঝেমধ্যে। খোঁজা হয় ছুঁতা। তা হোক সাইকেল চুরি নিয়ে বা এবারের মতো ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে। কোনো না কোনো অসিলায় মাঠে নেমে তারা পরিস্থিতির বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। নিয়ে আসে পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সরানোর দাবিনামা। এবারও ব্যতিক্রম নয়। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের উসকে দিয়ে পার্বত্য জনপদকে অশান্ত-অনিরাপদ করে দাবিটির যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা এবারও।
পার্বত্যাঞ্চলে সাম্প্রতিক ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত পাঁচজনের মধ্যে দুজন হিন্দু, একজন মারমা এবং দুজন চাকমা সম্প্রদায়ের। এরই মধ্যে পাকড়াও করা হয়েছে তাদের একজন নয়ন শীলকে। অথচ অভিযোগটির বাঁক ঘুরিয়ে কয়েকটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনকে দিয়ে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে নেওয়ার জোর তৎপরতা। তাদের উসকানিতে এলাকায় মসজিদ ভাঙচুর ও সেনাক্যাম্পে হামলার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি, সেনাক্যাম্প সরানোর। সাম্প্রতিক এ ঘটনাকেও নিয়েছে যুতসই অজুহাত হিসেবে। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভুল বার্তা পাঠানো এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে দুর্বল করার নতুন একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল এই চক্র। স্থানীয় বাঙালি-পাহাড়ি উভয়ের বেশির ভাগই শান্ত প্রকৃতির। একেও সুযোগ হিসেবে নিয়ে উসকানিমূলক কাজে জড়িয়ে নিয়েছে।
গত বছরও এ মাসটিকেই বাছাই করেছিল তারা। ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলচালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে। জড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে। ওই ঘটনার এক বছর পূর্তির মতো এ বছরও খাগড়াছড়িতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের অভিযোগকে আমলে নিয়ে ইউপিডিএফের দাবি করা সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। নেওয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। ঘটনাটির সত্যতা বিচারে আইনি প্রক্রিয়া চলমান। শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপির নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রতিবাদী মানববন্ধনের ডাক দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফের আহ্বানে খাগড়াছড়িতে অর্ধবেলা হরতাল পালন করা হয়। একই সময় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ব্লগার এবং পার্বত্যাঞ্চলের কিছু ব্যক্তি অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করে। পরিকল্পনা মতো, ২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ কর্মী উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং সামাজিক মাধ্যমে দেশি ও প্রবাসী ব্লগারসহ পার্বত্য জেলার কিছু ব্যক্তির উসকানিমূলক প্রচারণা। এর জেরে গোটা খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা। অবরোধ চলাকালে এক পর্যায়ে ইউপিডিএফের প্ররোচনায় উচ্ছৃঙ্খল এলাকাবাসী টহলরত সেনা দলের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে।
এমন উসকানির মধ্যেও সেনাবাহিনী ধৈর্য, সংযম ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বল প্রয়োগে যায়নি। ২৭ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ এবং অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা আবারও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায়। ভাঙচুর, অ্যাম্বুল্যান্সে আক্রমণ, রাস্তা অবরোধসহ নাশকতাও বাদ দেয়নি। খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকার আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটাতে তারা সক্ষম হয়। দিনেদুপুরে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। অবস্থা বিবেচনায় জেলা প্রশাসন খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এর পরও হাল ছাড়ছে না মতলববাজরা। খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকায় দাঙ্গা বাধাতে না পেরে ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাধারণ জনগণকে উসকে দেয়। অবরোধ করে গুইমারা-খাগড়াছড়ি রাস্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। লিপ্ত হয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায়। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইটপাটকেল, গুলতি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। রামগড় এলাকায় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করে এবং বিজিবি সদস্যদের আহত করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর টহল দল দ্রুত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে। গত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট, ইউপিডিএফ হাল ছাড়ছে না।
গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকেই অস্থিতিশীল করার সুপরিকল্পিত ছকে এগোচ্ছে তারা। এলাকার নারী ও স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে টেনে আনছে। বহিরাগত সন্ত্রাসীদেরও জড়ো করেছে। পার্বত্য জনপদকে অশান্ত করতে নতুন করে তাদের একটা মরণকামড় স্পষ্ট। আর তাদের বড় টার্গেট সেনাবাহিনী। ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র সেনাপ্রধানের সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে ব্যর্থ হওয়ার একটি প্রতিশোধ প্রবণতা কাজ করছে বিতাড়িতদের মধ্যে। লক্ষণ বলছে, নতুন করে পাহাড়ে একটি সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশ্ব নেতারা তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্তের হুমকি মোকাবেলার দায়িত্ব আমাদের সেনাবাহিনীকেই পালন করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন অভিযানের শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজে শামিল হচ্ছে অন্য বাহিনীগুলোও। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি বাংলাদেশের অন্য ৬১টি জেলার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ‘শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সারাক্ষণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। সেখানে কেবল নিরাপত্তা নয়, সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি বাড়াতেও নানা মাত্রায় কাজ করছে সেনাবাহিনী। সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কার্যকর করছে নানা পরিকল্পনা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিন-রাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নতুন রাস্তা তৈরি নয়, ভূমিধস বা অত্যধিক বৃষ্টিতে ভেঙে পড়া রাস্তা মেরামত, যাতায়াতের সুবিধার্থে ছোট ছোট নদী ও খালের ওপর সেতু ও সাঁকো তৈরির কাজও করছে।
বাংলাদেশের সর্বাধিক উচ্চতাবিশিষ্ট থানচি-আলীকদম সড়ক, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক, বাঘাইহাট-সাজেক সড়ক, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই করেছে। পার্বত্যাঞ্চলে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী স্থানীয়দের সমবায় সমিতির মাধ্যমে গভীর নলকূপ স্থাপনে সহায়তা করছে। এতে বিভিন্ন এলাকা একদিকে যেমন সেচের আওতায় আসছে, অন্যদিকে স্থানীয়দের খাবার পানির অভাব দূর করছে। পার্বত্যাঞ্চলের পানি ও বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। প্রান্তিক চাষিরা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহনে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখছেন। এ ছাড়া বনজ সম্পদ রক্ষাকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ ব্যবস্থাপনায়, আবার কখনো বিভিন্ন এনজিও ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ের মাধ্যমে পর্যাপ্ত বনায়ন করছে। পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখণ্ড বরাবরই আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় তিন পার্বত্য জেলায় এ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। সেখানেও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে সেনাবাহিনীর কর্মযজ্ঞ ব্যাপক। যোগাযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও রাত্রি যাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় এখন হাজার হাজার সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
পার্বত্য অঞ্চলের হতদরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালি মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণ ও প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। এসব কাজের সুফল মিলছে। এতে একদিকে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে, আরেক দিকে হিংসার আগুনে পুড়ছে পাহাড়ি কিছু শক্তি। তাদের সঙ্গে মিলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবিশেষ শুধু পাহাড়িদের বঞ্চনা এবং অত্যাচারিত হওয়ার নির্বাচিত অংশবিশেষের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতি আদায় করেন। কিছু লোকের জন্য সহানুভূতি আদায়ের এই পদ্ধতি অন্য অনেক লোকের প্রতিও এক ধরনের বঞ্চনার সৃষ্টি করছেন। আর কথার ফাঁকে জ্ঞান দিতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুই কথা বলে স্মার্টনেস দেখানোর বাতিকও কাজ করে তাঁদের কারো কারো মধ্যে। পাহাড়ে টেকসই শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ফাঁকফোকর বন্ধ করতেই হবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন