বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য চাহিদা। অন্যদিকে কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা।
আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯ বিলিয়নে দাঁড়াবে। তখন খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে প্রায় ৭০ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের সঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব নেতিবাচক।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বের ১০৯টি দেশের ৬৩০ কোটির মধ্যে ১১০ কোটি অর্থাৎ প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে ভুগছে। জলবায়ুর ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ। পোভার্টি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৮ কোটি মানুষ অন্তত একটি জলবায়ু সমস্যার সরাসরি সম্মুখীন। এর মধ্যে ৬০ কোটি চরম তাপে, ৫৭ কোটি দূষণে, ৪৬ কোটি বন্যায় এবং ২০ কোটি খরায় ভুগছে।
এতে শিশুমৃত্যুর হার, বাসস্থান, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ঘন ঘন বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের কারণে এরই মধ্যে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষির উৎপাদন। তা ছাড়া অবকাঠামো বিনষ্ট হচ্ছে। সাধিত হচ্ছে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি।
আশঙ্কা করা হচ্ছে যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব না হলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ জিডিপির প্রবৃদ্ধির ৬.৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। এ সময় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২৮ শতাংশ ধান এবং ৬৮ শতাংশ গমের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ ০.৬৫ মিটার বৃদ্ধি পেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৪০ শতাংশ উর্বর জমি ডুবে যেতে পারে। ফলে দারুণভাবে বিঘ্নিত হতে পারে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষিতে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এখন আর প্রথাগত কৃষি প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে অগ্রসরমাণ প্রযুক্তির। অনুসরণ করতে হচ্ছে ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার বা জলবায়ু অভিযোজিত, জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তির। এটি এমন একটি কৌশল, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে, এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। এর মূলে রয়েছে অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হচ্ছে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, উৎপাদনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) কমানো।
বাংলাদেশে জিএইচজি নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ২৮১.৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমমান। এর গঠনে রয়েছে ৪৪.৮ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড, ৪০.১ শতাংশ মিথেন এবং ১৩.১ শতাংশ নাইট্রাস অক্সাইড। মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বেশির ভাগ নির্গমন হয় শস্য খাত ও পশুসম্পদ খাত থেকে। আমাদের বার্ষিক জনপ্রতি নিঃসরণ প্রায় ১.৬১ মেট্রিক টন কার্বন-ডাই অক্সাইডের সমমান। এনার্জি সেক্টর বা শক্তি খাত থেকে জিএইচজি নিঃসরণের মাত্রা বেশি, প্রায় ৫৫.৭ শতাংশ। শস্য, পশুপাখি, মৎস্য ও বন তথা সমন্বিত কৃষি খাত থেকে নিঃসরিত হয় ৩৭.৩৫ শতাংশ, আবর্জনা থেকে ১৪.২৬ শতাংশ এবং শিল্পপ্রক্রিয়া থেকে ৩.৩২ শতাংশ। এনার্জি খাতের কার্বন নিঃসরণ মূলত বিদ্যুৎ, যানবাহন, শিল্প, বসতবাড়িতে ব্যবহৃত শক্তি এবং ইটভাটা থেকে আসে। কৃষি খাত থেকে নিঃসৃত মিথেন প্রধানত ধান চাষ, গবাদি পশুর পাচকপ্রক্রিয়া ও মলমূত্র থেকে আসে। ইউরিয়া ও ডিএপি সারের প্রয়োগ থেকে নিঃসরিত হয় নাইট্রাস অক্সাইড। তা ছাড়া বনভূমি উজাড়, খড় পোড়ানো ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে আসে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। বর্তমানে ফসল খাত থেকে প্রায় ৪১ শতাংশ, পশুপালন খাত থেকে ৫২ শতাংশ এবং মৎস্য খাত থেকে প্রায় ৭ শতাংশ মিথেন নিঃসরিত হচ্ছে।
জিএইচজি নির্গমনের জন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তাকে বলে এনডিসি বা ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত তৃতীয় জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান বা এনডিসি ৩.০ অনুসারে ২০৩৫ সাল নাগাদ শর্তহীনভাবে নিজস্ব প্রচেষ্টায় ৬.৩৯ শতাংশ জিএইচজি নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বিদেশি অর্থায়ন ও সহায়তাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে আরো ১৩.৯২ শতাংশ কমানো হবে। মোট নির্গমন কমানোর পরিমাণ দাঁড়াবে ২০.৩১ শতাংশ। খাতওয়ারিভাবে শক্তিতে ২৬.৬৬ শতাংশ, শিল্পে ৭.৭১ শতাংশ এবং সার্বিক কৃষিতে ১১.৪৬ শতাংশ জিএইচজি নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ফসল খাত, পশুপালন খাত ও মৎস্য খাত থেকে নিঃসরণ ক্রমাগত বেড়েছে।
কৃষি খাতে প্রশমন কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাসায়নিক সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, পশুপালন ও মৎস্য চাষের ব্যবস্থাপনা উন্নত ও বিজ্ঞানভিত্তিক করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মাটির নিচে ইউরিয়া সার প্রয়োগ, মাটির এসিডিটি নিরসনে চুন ব্যবহার, পানি সেচের ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল শুকানো ও ভেজানো পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রিসিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নির্ধারণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পশুপালনের ক্ষেত্রে ভালো মানসম্পন্ন খাবার এবং উত্তম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে। পানি সেচ ও মৎস্য আহরণের ট্রলারে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রযুক্তির ধারণ করা হচ্ছে। তবে কৃষিতে জিএইচজি নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে সার্বিক প্রচেষ্টা এখনো সীমিত। গবেষণায় অগ্রগতি কম।
অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খাপ খাওয়ানো কর্মসূচি কৃষিতে বেশ দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে তা ধারণের অনেক দৃষ্টান্ত আমাদের রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্বল্প জীবনকাল, লবণসহিষ্ণু, বন্যাসহিষ্ণু এবং খরাসহিষ্ণু বিভিন্ন ধানজাতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এই জাতগুলোর উদ্ভাবক। গম, ভুট্টা, পাট ও নেপিয়ার ঘাসের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্ভাবন রয়েছে। তবে গবেষণার ক্ষেত্র থেকে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ পর্যন্ত প্রযুক্তি হস্তান্তরে সময়ের ফারাক অনেক বেশি, যা কমানো সম্ভব। এ ছাড়া শস্য পর্যায়ক্রম, শস্য বহুমুখীকরণ, আন্ত ফসল চাষ এবং শস্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করার প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর। অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, মাটির ধরন ইত্যাদি বিবেচনায় ফসলের পর্যায়ক্রম ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন—বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য একটি ফসল পর্যায়ক্রম এবং সমতলের জন্য অন্যটি দৃশ্যমান। এটি এমনভাবে অনুসরণ করা হয়, যাতে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং পাশাপাশি অধিক ফসল ও অর্থনৈতিক লাভজনকতা নিশ্চিত করা যায়। এতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দেশের কৃষিবিদ ও কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎপাদন বৃদ্ধিও পেয়েছে। এখনো নিট ফলাফল ইতিবাচক। ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। এর জন্য গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের আর্থিক সহায়তা ও নীতিগত সমর্থন বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং সহনশীল প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে অগ্রসরমাণ কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষক, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী, বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী এবং বেসরকারি ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কাজের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এতে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো অর্থায়ন। এ নাগাদ জলবায়ু কর্মসূচির অর্থায়নে কৃষি খাতের হিস্যা খুবই কম।
আগামী ২০৩৫ সাল নাগাদ জিএইচজি নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বাংলাদেশের খরচ হবে প্রায় ১১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ২৩ শতাংশ সংস্থান করবে দেশের সরকার। বাকি ৭৭ শতাংশ আসতে হবে বিদেশি অর্থায়ন থেকে। এই অর্থ জোগাড় করা বেশ কঠিন। এটি নির্ভর করবে বাংলাদেশের দর-কষাকষি করার দক্ষতার ওপর। নভেম্বর ২০২৫-এর ১০ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কপ-৩০ সম্মেলন। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আমাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরতে পারবেন। শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারবেন বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং ক্ষতি ও লোকসান সহায়তা আদায়ের জন্য। সে ক্ষেত্রে কৃষি মূল আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ