বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও পুনরুজ্জীবিত করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তবে এবার নয়, কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।
গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। এ আদালতের আগের রায়টিকে (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের রায়) ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত বলেও মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতি হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভূঞা, মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ, মোহাম্মদ অনীক আর হক, আপিলকারী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শিশির মনির, সুজন সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার ও তার পক্ষে ড. শরীফ ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৪ বছর আগে (২০১১ সাল) রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল এবং এ-সংক্রান্ত রিভিউ আবেদনের ওপর ১১ নভেম্বর শুনানি শেষে রায়ের জন্য গতকালের দিন ধার্য করেছিলেন আপিল বিভাগ। এ ধারাবাহিকতায় গতকাল রায় দেওয়া হয়। এদিন সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটের দিকে প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। এরপর রায়ের সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর অংশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ার পর দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে দেশের গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। গতকাল আপিল বিভাগের রায়ের পর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
দেশের বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট রায় দেয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি সেটা মনে করি না। কোনো রায় রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, আর কোনো রায় আইনি ব্যাখ্যায় দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে, গণতন্ত্র রক্ষা করবে, মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করবে, আইনের শাসন রক্ষা করবে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বহাল করবে, তা জাতি বিবেচনা করবে।
এই রায়ে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান পুনরুজ্জীবিত করার রায়ে আনন্দিত সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের আজকের রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। গতকাল রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন রিভিউ আবেদনকারীদের একজন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তার মাধ্যমে দেশের নির্বাচনিব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলে গত তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। আজকের রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর আদালত রিভিউ পিটিশনটা গ্রহণ করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন।
ঘটনার পূর্বাপর : এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দেশে সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন। সেই সরকারের প্রধান ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তখন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৯ সালে একটি রিট করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ রায় দেন। সেই রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ। এই আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪:৩) ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন।
রায় কার্যকর চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে : রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও পুনরুজ্জীবিত করা হলেও ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে এ রায় কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, রায়ের এমন নির্দেশনার ফলে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ রায়ের কোনো প্রভাব পড়বে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে এ নির্বাচন। পরবর্তী চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
গতকাল আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর এমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
রায়ের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে এ রায় প্রসপেকটিভ (ভবিষ্যন্মুখী)। অর্থাৎ আসন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে না। চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তিনি বলেন, ‘শুনানির সময় বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের আর্জি ছিল আদালত যেন রায়টি প্রসপেকটিভ বলে ঘোষণা করেন। সেই আর্গুমেন্ট আদালত গ্রহণ করেছেন।’
বিএনপি মহাসচিবের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলেও এর কার্যকারিতা ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে এটা এখনই সংবিধানে ফিরলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা আয়োজনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। পরবর্তী নির্বাচন থেকে এ রায় কার্যকর হবে।’
রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বহাল করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এ পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বহাল হওয়াটা সংবিধানের ৫৮বি ও ৫৮সি অনুচ্ছেদ সাপেক্ষে প্রয়োগ-কার্যকর হবে। ওই অনুচ্ছেদে আছে-সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন সংসদ নেই। তাই আদালত বলেছেন, সামনে থেকে কার্যকর হবে, এখন নয়।’ তাই আসন্ন নির্বাচনে এ রায়ের প্রভাব পড়বে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বদিউল আলম মজুমদারসহ আপিলকারী চার বিশিষ্ট ব্যক্তির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে (বৃহস্পতিবার) রায়ে আদালত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া রায়টি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফিরে এলো।’