আগামী তিন-চার কর্মদিবসের মধ্যেই গণভোট আইন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘গণভোট আইন আমরা খুব দ্রুত করতে যাচ্ছি। আগামী তিন-চার কর্মদিবসের মধ্যে এটা হয়ে যাবে।’
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে ওই দিনেই গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই গণভোট নিয়ে এখনো অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় এ ব্যাপারে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে গণভোট আইন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন। শফিকুল আলম বলেন, উপদেষ্টা পরিষদে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন। এ ছাড়া ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ৫১টি বৈঠকের অগ্রগতি প্রতিবেদন বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসিফ নজরুল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের অনুমোদন ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয় কাজটা করে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতের বিচারকদের জামিন বা সাজার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। এই অধ্যাদেশ পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার পর এ অবস্থার অবসান ঘটবে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের অর্থাৎ সরকারের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এ অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার পর নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ (বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলাজনিত বিষয়, ছুটিসংক্রান্ত বিষয়, বিচারকদের নিয়োগ, কাজের শর্তাবলি নির্ধারণ ইত্যাদি) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় করবে। শুধু বিচার বিভাগীয় যেসব কর্মকর্তা বা বিচারক বিভিন্ন জায়গায় (নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদি) প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি কাদের নিয়ে করবেন, কত দিনে করবেন, কীভাবে অর্গানোগ্রাম সাজাবেন- এটা তার এখতিয়ার। আমার ধারণা এটা এক-দুই মাসের ব্যাপার।
আসিফ নজরুল বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের আর্থিক স্বাধীনতার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের উন্নয়নে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রধান বিচারপতি নিজেই অনুমোদন করতে পারবেন। ভবিষ্যতে প্রকল্প সংশোধিত হলে তখন আরও ৫০ কোটি টাকা অনুমোদন দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি। এটা আর্থিক স্বাধীনতার একটা দিক। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের বাজেট অনুমোদন করার পর তা ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা উচ্চ আদালতের থাকবে। বাজেট বা আর্থিক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়গুলো এ আইনটা গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলার বিষয়গুলো সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকরা অসদাচরণ করলে সচিবালয় দেখবে। প্রশাসনিক কাজে কর্মরত বিচারকদের বিষয় আইন মন্ত্রণালয় দেখবে। বিচার বিভাগে আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখবেন মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেয়েছিলাম, যেটা আমাদের ভোটের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। বেশ কয়েকটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেছিলাম। সব সময় ব্যর্থতার দায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত হতে দেখতাম। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে রায় দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে সংবিধান থেকে বাতিল করে। মাস দুয়েক আগে একটা রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবের রায় গতকাল বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বিধান অনুযায়ী পরবর্তী সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন যেহেতু কোনো সংসদ নেই, তাই আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই।
এ সময় আসিফ নজরুল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতকে আমরা চিঠি দিচ্ছি। আমরা মনে করি বাংলাদেশের মানুষের বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য ভারতের দায়িত্ব বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দেশে ফেরাতে রোমের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কোনো ‘অ্যাপ্রোচ’ করতে পারি কি না সেটা বিচার-বিবেচনা করতে অচিরেই বসে সিদ্ধান্ত নেব।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, গতকাল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া নীতিগত চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হয়। আরও আলোচনার জন্য এটা ফেরত পাঠানো হয়েছে। মানব পাচার ও চোরাচালান দমন নিয়ে অধ্যাদেশের খসড়া নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিজমি সুরক্ষা অধ্যাদেশে কৃষিজমিকে অকৃষি কাজে ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কৃষিজমির অননুমোদিত পরিবর্তনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।