হাতে সময় আছে তিন মাসেরও কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার বলেছেন, এবার খুবই ভালো একটি নির্বাচন হবে, যেমনটি এ দেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। সিইসি নিজেও অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও রয়েছে আশানিরাশার দোলাচল। ইলেকশন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করছে। তুলনামূলকভাবে ছোট দলগুলোর বেশির ভাগই অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নে কমিশনকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কালোটাকার ছড়াছড়ি ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে তাদের সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। জাল ভোট ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছে কোনো কোনো দল। বড় দলগুলো নির্বাচনি আচরণবিধি মানছে না বলেও নালিশ করা হয়েছে। ইলেকশন শিডিউল ঘোষণার আগে আচরণবিধি মানা না-মানার প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা, সেটাও অবশ্য একটা প্রশ্ন।
ইলেকশনে যখন কালোটাকার ছড়াছড়ির কথা বলা হয়, তখন আসলে দুর্নীতির টাকার কথাই বলা হয়। যে সমাজে দুর্নীতি আছে, সেই সমাজের ভোটে কালোটাকার লেনদেন হবে না, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তার পক্ষে সর্বব্যাপী দুর্নীতি রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। কালোটাকার দাপট কমাতে ইলেকশন মৌসুমে কমিশন আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, তাতে কালোটাকার আস্ফালন কতখানি কমিয়ে আনা সম্ভবপর হয় তা নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তার অবকাশ রয়েছে। কোনো পোস্টার না ছাপানো, বিলবোর্ডের সংখ্যা সীমিতকরণ, মাইকের ভলিউম ও ব্যবহারের সময় সীমিতকরণের মতো বিধি বা পরিবেশদূষণ রোধ করতে প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয় উপকরণ ব্যবহারের বিধিনিষেধ কালোটাকার রাশ টেনে ধরতে কতখানি কাজ করতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কালোটাকা বা দুর্নীতির অর্থ যখন ভোটের বাজারে দেদার ব্যয় হয়, তখন তা সমাজদেহে মারাত্মক বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয়, ইলেকশনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। প্রচলিত নিয়মে জনগণের বৃহদাংশের ইচ্ছা ক্ষুদ্রাংশের ওপর প্রাধান্য পায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকার নেই। ধরে নেওয়া হয় পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আন্তর্জাতিকভাবে সাবালক হওয়ার বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হলেও কোনো কোনো দেশে ১৬-১৭ বছরের নাগরিকদেরও ভোটাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু ১৬ বছরের নিচে কেউ ভোটার হতে পারে না। বাংলাদেশে যে নিয়ম রয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমরা বলছিলাম জনগণের ম্যান্ডেট বা ইচ্ছা প্রসঙ্গে। প্রশ্ন হলো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের একটা অংশ যদি দারিদ্র্য, অসচেতনতা বা লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের ইচ্ছাটাকেই বিক্রি করে দেয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াল! যে ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করল, তার কাছে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির জবাবদিহি থাকতে পারে না। জবাবদিহি দাবি করার মতো নৈতিক সাহসও সেই নাগরিকের থাকবে না; এটাই স্বাভাবিক। দারিদ্র্য, লোভ বা অসচেতনতার সুযোগে কালোটাকার শক্তি কালকেউটের মতো মানুষের নৈতিকতার শক্তিমূলে ছোবল হানে। আর তখন গণতন্ত্র হারায় তার প্রাণের শক্তি।
নির্বাচনি আচরণবিধি কি আটকে দিতে পারবে কালোটাকার ধোঁকা? তবে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল ও প্রার্থী যদি আন্তরিকভাবে চান যে তারা অনৈতিক পন্থায় ভোটারদের প্রভাবিত করবেন না, তাহলে কিছুটা সুফল পাওয়া গেলে যেতেও পারে। কিন্তু সে ধরনের ঐকমত্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
খাঁটি কথাটি হচ্ছে, সমাজে দুর্নীতির চাকা সচল থাকবে আর ভোটে তার প্রভাব পড়বে না, এ তো সোনার পাথরবাটির মতো এক অসম্ভব কল্পনা। সত্য সব সময় সুন্দর হলেও তা সব সময় সবার কাছে সমানভাবে প্রীতিপ্রদ নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে ৫৪ বছর ধরে আমরা দুর্নীতি নামক বিষচক্রের মধ্যে যেভাবে খাবি খাচ্ছি তা বলে শেষ করা যায় না। গত বছর ৫ আগস্টের পর আমরা নতুন বাংলাদেশের একটা স্বপ্্ন পেলাম। আমরা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখলাম বা আমাদের দেখানো হলো, যেখানে কোনো দুর্নীতি থাকবে না, থাকবে না বৈষম্য। কিন্তু বাস্তবে- ‘সকলই গরল ভেল।’ আসলে আমাদের কেবল স্বপ্নই দেখানো হয়। আর স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা যেন বা স্বপ্নচারীই হয়ে গেলাম। আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল ব্যাকেটের ওয়েটিং ফর গডো নামের অ্যাবসার্ড বা অযৌক্তিক থিয়েটারের কথা মনে পড়ে। ওই থিয়েটারে দুই ভবঘুরে দিনমান অপেক্ষা করে গডো নামের এক আগন্তুকের জন্য। সেই মহান আগন্তুক এসে তাদের নাকি উদ্ধার করবে। কিন্তু অপেক্ষার আর শেষ হয় না। এক অলৌকিক দূত কেবল বার্তা নিয়ে আসে, তিনি আসবেন, তবে আজ নয়, কাল। আমাদেরও হয়েছে সেই দশা। রাষ্ট্র সংস্কারের স্লোগান দিয়ে যারা বিপ্লবী হলেন, তাদের বিরুদ্ধেও এখন গন্ডায়গন্ডায় দুর্নীতির অভিযোগ। এনসিপির প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে যেমন তদবিরের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার করাপশনের অভিযোগ রয়েছে, তেমনই অভিযোগ রয়েছে ছাত্র উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধেও। সবচেয়ে ভোকাল ও সাহসী বলে পরিচিত নেতারাও এ অভিযোগের বাইরে নন। সম্প্রতি বহিষ্কৃত একজন নেতা নাম ধরে ধরে পার্টির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রে তা বিস্ফোরক অভিযোগ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির আদিগন্ত বিস্তৃত যে ধূসর ক্যানভাস তার অনেকটা জুড়েই এখন জুলাই বিপ্লবীদের একটি দলের এনসিপি নামের বিপ্লবী দলটির নীতিনির্ধারকদের কারও কারও তুলির অরুচিকর আঁচড়। জনান্তিকে বলে রাখা ভালো, যেসব নেতার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির প্রচার রয়েছে, তাদেরও অনেকে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে। তাদের সেই অবৈধ টাকা ইলেকশনে ব্যয় করা হবে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে? অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতির ভলিউম বেড়েছে বৈ কমেনি। ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পাতায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়, বৈষম্যমুক্ত নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার ডাক দেওয়া হয় গত বছরের ৫ আগস্টের পর। সংস্কারের জন্য গঠিত হয় নানা কমিশন। কিন্তু দুর্নীতি চলছে আগের মতোই অপ্রতিরোধ্য গতিতে। প্রকাশিত রিপোর্টে যেসব তথ্য ফাঁস করা হয়েছে, তাতে প্রতীয়মাণ হয় যে জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে শত বা হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে বদলি ও পদায়ন বাণিজ্য হয়নি। উৎকোচের এই বস্তাভরা টাকা কোথায়? দুর্নীতির এসব টাকা আসন্ন নির্বাচনে খরচ হবে না, সেটিই বা কে বলতে পারে! ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামতের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করল। এজন্য জাতীয় নির্বাচনও বিলম্বিত হলো। অথচ যে দুর্নীতি ঘুণপোকার মতো রাষ্ট্রের কড়ি-বরগা কেটে ভুসি বানিয়ে দিতে চাইছে, সেটাই বন্ধ হলো না। সেখানে সংস্কারের বালাই নেই।
সংস্কারবাদী সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা একবারও কী ভেবে দেখেছেন, শত কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে যে অফিসার সুবিধাজনক (যেখানে ঘুষনামক কীট কিলবিল করে নর্দমার মতো) জায়গায় পোস্টিং নিলেন, তিনি কি সাধুসন্তের জীবন বেছে নেবেন? নাকি ঘুষের টাকা তুলতে বেপরোয়া হয়ে যাবেন? তিনিও কি জনগণের সঙ্গে ঘুষের বাণিজ্য করবেন, নাকি করবেন না! এভাবে জন্ম নিচ্ছে দুর্নীতির এক বিষচক্রজাল! যে রাষ্ট্রে ঘুষের অভিযোগ উঠলেও আইন তার লম্বা হাতটি ততোধিক লম্বা কোটের হাতার ভিতর গুটিয়ে রাখে সেই রাষ্ট্র কে মেরামত করবে? দুর্নীতি আমাদের গণতন্ত্রের ভিতটাকেও নড়বড়ে করে দিচ্ছে, চুরমার করে দিচ্ছে জনগণের নৈতিক শক্তির পাটাতন।
আমলাতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা দক্ষিণ গোলার্ধের আরও অনেক দেশের মতো আমাদের রাজনৈতিক সমাজেরও একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমলা ছাড়া রাষ্ট্র চলে না। আমলারা সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করেন। সিটিজেন চার্টার মেনে নাগরিক সাধারণকে সেবা দেওয়া তাদের কাজ। সেই আমলাতন্ত্রকে আপাদমস্তক দুর্নীতির পঙ্কে ডুবিয়ে দেওয়ার যে আয়োজন চলেছে, তাতে বিচলিতবোধ না করে পারা যায় না। তবে ইন্টেরিমের পনেরো মাসের শাসনকালে ভালোমন্দ যা হওয়ার হয়েছে। ঘোষিত সময়ে গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। বস্তুত দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রহণ করতে হবে জিরো টলারেন্স নীতি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে নির্বাচিত সরকারকে হতে হবে আপসহীন, নিরাসক্ত। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে নৈতিক প্রতিরোধ। পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষার ওপর আরোপ করতে হবে সবিশেষ গুরুত্ব। পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলেও নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী নাগরিক সাধারণের আয়-রোজগারের পথগুলোকে করতে হবে কণ্টকমুক্ত।
চাঁদাবাজি এবং ট্যাক্সেশানের বোঝা কমিয়ে ন্যায্য বাণিজ্যের পথ সুগম করতে হবে। চাকরিজীবী-পেশাজীবীর বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে হবে বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে, যাতে প্রতিটি পরিবার নিজেদের বৈধ আয় দিয়ে যাপন করতে পারে অভাবমুক্ত জীবন। এটা করতে পারলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হতে কোনো নৈতিক বাধা থাকবে না। মোটকথা বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব দুর্নীতির মূলোৎপাটন। এটাই হওয়া উচিত রাষ্ট্র মেরামতের প্রথম সূত্র।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক