দুটি শিশু তাদের মায়ের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি। একজনের বয়স পাঁচ বছর, অন্যজনের দুই। একজনের দুরন্ত শিশুকাল, অন্যজন মাত্র একটু একটু করে হাঁটতে শিখছে। বড়ভাই ছোটভাইকে আদর করে, জড়িয়ে ধরে। দুই ভাই একসঙ্গে খেলা করে। কিন্তু সারাক্ষণ বাসার ভিতরে পাঁচ বছরের একটি শিশু কতক্ষণই বা থাকতে পারে! সে খেলবে, দৌড়াবে, হইচই করবে-এটাই তো বয়সের স্বাভাবিকতা। কিন্তু না, তাকে ঘরের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে পারছে না। এমনকি বাসার বাগানেও যেতে পারছে না। কারণ সে গৃহবন্দি। মা শুধু বলেন, ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। বাড়ির গেটের সামনে দণ্ডায়মান রক্ষীরা বলেন, বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন বাসার বাইরে যাওয়া যাবে না, বাগানে খেলতে যাওয়া যাবে না সেটা কেউ বলছে না। শিশুটিও বুঝতে পারছে না, কেন তাকে খেলতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। মা জানেন, দুই সন্তান নিয়ে তিনি গৃহবন্দি। রক্ষীরা জানেন, বাসার ভিতরে এক মা ও দুই শিশু গৃহবন্দি। তাদের এ বন্দিদশার কারণ তাদের পিতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে গেছেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। গৃহবন্দি অবস্থায় কেটেছে ৯ মাস। যে শিশুর জীবনটা শুরুই হয়েছে গৃহবন্দি অবস্থায়, সে শিশুটি এখনো দীর্ঘ পরবাসী। ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কেটেছে তার জীবন। হারিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি পিতাকে। দেখেছেন মায়ের কষ্টকর, আপসহীন রাজনৈতিক জীবন। অকালে হারিয়েছেন খেলার সাথি প্রিয় ছোটভাইকে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নিজেকে দেশান্তরী হতে হয়েছে। নানা রকম ষড়যন্ত্র, বঞ্চনা, প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে তিনি এখন পরিণত রাজনৈতিক নেতা। সেই ছোট্ট গৃহবন্দি শিশুটি এখন সারা দেশের লাখো-কোটি নেতা-কর্মী-সমর্থকের কাছে প্রিয় নেতা তারেক রহমান। আজ তাঁর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তারেক রহমান। এ জন্মদিন উপলক্ষে দলের নেতা-কর্মীদের কেক কাটা, পোস্টার বা ব্যানার লাগানো, আলোচনা সভাসহ কোনোরকম আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান না করার নির্দেশনা জারি করেছে বিএনপি। আজকের দিনটি দেশে-বিদেশে যারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী তারাসহ অগণিত মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই জাতীয়তাবাদের একমাত্র বিশ্বস্ত ঠিকানা। সেই ঠিকানার উত্তরাধিকার হলেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান।
নভেম্বরে যাদের জন্ম তাদের অনেকেই জগদ্বিখ্যাত। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নোবেলজয়ী মিখাইল গর্বাচেভের জন্ম ২ নভেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্ম ১৪ নভেম্বর। ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ১৯ নভেম্বর। নোবেলজয়ী অং সান সু চির জন্ম ১৯ নভেম্বর। ২০ নভেম্বর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গলের জন্ম ২২ নভেম্বর। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের জন্ম ৩০ নভেম্বর। প্রথম নারী নোবেলজয়ী মেরি কুরির জন্ম ৭ নভেম্বর। এ ছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন যাঁদের জন্ম হয়েছে নভেম্বরে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হলো। গুজরাটি জিন্নাহ বুঝতে পেরেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র দরকার। তখনো মুসলমানদের একটি অংশ অখণ্ড ভারতের পক্ষেই ছিল। মুসলমানদের ওই অংশের আপত্তি সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে পাকিস্তান নামের সেই রাষ্ট্রে একসঙ্গে থাকতে পারল না মুসলমানরা। আলাদা রাষ্ট্র, আলাদা পতাকার জন্য ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করল। বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। দেশের জন্য লাল-সবুজের পতাকা হলো। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৪৭ সালে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না, ১৯৭১ সালে তারাই পাকিস্তানের ‘পেয়ারে দোস্ত’ হয়ে গেল। দেশটা স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিল দেশের মানুষ এবং তাঁর নামেই আওয়ামী লীগ সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিল। তার আগেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠা শেখ মুজিব হয়ে যান ‘বঙ্গবন্ধু’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু মাত্র তিন বছর সাত মাস চার দিনের ব্যবধানে আকাশচুম্বী জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব নিজের বাড়িতেই নিহত হন। ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুর ঘটনা ইতিহাসের অনিবার্য অধ্যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিবের অতিবিশ্বস্ত, আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী রাজনীতির উত্থান ঘটে। তারপর অনেক নদীর পানি অনেক দিকে গড়াল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসলেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছর ছিল তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই শাসন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও পিতার স্বপ্ন ফেরি করার মুখোশ পরে তিনি মূলত দেশবাসীর ওপর পিতা, মাতা, ভাই ও স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার হরণ করার জন্য যা যা দরকার, তিনি তা-ই করেছেন। গুমখুন তো ছিল তাঁর নিত্যদিনের ঘটনা। পতনের আগে ৩৬ দিনেই তিনি যেভাবে মানুষ হত্যা করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই বিরল। দীর্ঘ দেড় দশকের নির্যাতন-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মানুষ যখন রুখে দাঁড়িয়েছে, তখন তিনি পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে চরম বিপদে ফেলে নিজের স্বজনদেরও নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য, অনেক সংসদ সদস্য, অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাবন্দি। কিন্তু তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের একজনও গ্রেপ্তার বা কারাবন্দি হননি। দেশবাসীর ওপর শেখ হাসিনার ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার বিচার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মৃত্যুদণ্ড ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশ এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ফ্যাসিস্টের বিচার করা ছিল দেশবাসীর কাছে বর্তমান সরকারের একটি প্রধান প্রতিশ্রুতি। সরকার সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে। অনেক ব্যর্থতা থাকলেও ফ্যাসিস্টের বিচার করার কারণে দেশবাসী সরকারকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছে। দেশবাসী উল্লাস করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছিল। এর মধ্যে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যাকাণ্ড এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আরেক মামলায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ে এ আদেশ দেন। এ ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। যেদিন শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হবেন, সেদিনই সাজা কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করে ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটির মতো অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে। পৃথিবীর যে কোনো আদালতে এ সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজ যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন।’ শেখ হাসিনার বিচারের রায় হওয়ার পর আলোচনা হচ্ছে এ রায় কীভাবে কার্যকর হবে? তাঁকে ভারত সরকার বাংলাদেশে ফেরত দেবে কি না, অথবা দণ্ড মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরবেন কি না। আলোচনা-সমালোচনা যা-ই হোক না কেন, বর্তমান বাংলাদেশে শেখ হাসিনার যে পরিণতি এর জন্য তিনিই দায়ী। নিজের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি যা করেছেন, সে কারণেই তাঁর ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে ওঠে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রতিবেশী দেশ ভারত যে নগ্ন ভূমিকা পালন করেছে, সে কারণেই বাংলাদেশে এখন স্মরণকালের সবচেয়ে ভারতবিরোধী আবহ তৈরি হয়েছে। নিজেকে চরম ফ্যাসিস্টরূপে আবির্ভূত করায় শেখ হাসিনার ন্যক্কারজনক পতন, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ইতিহাসে অনিবার্য অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে।
শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলের পতনের পর, দেশের রাজনীতিতে নতুন বাতাস বইছে। নতুন অনেক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের জন্ম হচ্ছে। পুরোনো দলগুলোর মধ্যেও নানানরকম মেরূকরণ চলছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার তার শেষ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করছে। কিন্তু রাজনীতিতে স্বস্তি-আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হচ্ছে না। এর মূল কারণ দলগুলোর মধ্যে যার যা প্রাপ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাপ্তির প্রত্যাশায় সবাই ঘোড়দৌড় দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকাই যাদের জন্য দুঃসাধ্য ছিল, তারা এখন ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে। দেশ নয়, জনগণ নয়, ক্ষমতা এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, দেশের রাজনীতি আপাতত আওয়ামী লীগমুক্ত মনে হলেও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ক্ষমতার লোভে কেউ যদি পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের রাজনীতি করে, তাহলে সবারই বারোটা বাজবে। সে কারণে সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা ধরে রাখতে হবে। আগামীর সুন্দর বাংলাদেশের জন্য সবার ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন