উহুদ যুদ্ধ চলছে। চারদিকে তরবারির ঝনঝনানি। জীবনমরণ লড়াই। হক আর বাতিলের লড়াই। ইমান ও কুফরের মাঝে তুমুল যুদ্ধ। কাফের সেনাপতি আবু সুফিয়ান (যিনি পরবর্তী সময়ে মুসলমান হয়ে সাহাবি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন। রাদিয়াল্লাহু আনহু আওয়াজ দেন-
‘তোমাদের মাঝে মুহাম্মদ (সা.) কি জীবিত আছে?’
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের এর জবাব দিতে নিষেধ করলেন।
আবু সুফিয়ান পুনরায় তিনবার আওয়াজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কি আবু কুহাফার পুত্র (আবু বকর সিদ্দিক রা.) জীবিত আছে? খাত্তাবের পুত্র ওমর (রা.) জীবিত আছে?
আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু বললেন না।
অবশেষে আবু সুফিয়ান তাদের দেবতা হুবালের নামে স্লোগান দিলেন, ‘উলু হুবাল, উলু হুবাল’, যার অর্থ, হে হুবাল! তোমার শির উঁচু হোক!! হুবালের মর্যাদা সবচেয়ে ঊর্ধ্বে!!!
এবার আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর চুপ থাকতে পারলেন না। সাহাবিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কি আবু সুফিয়ানের এই কথার উত্তর দেবে না?
সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমরা তার জবাবে কী বলব?
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা বলো, ‘আল্লাহু আ’লা ওয়া আজাল্ল’ যার অর্থ, (আল্লাহতায়ালাই সবচেয়ে উঁচু ও মর্যাদাবান। অন্য ভাষায় ‘আল্লাহু আকবার’- আল্লাহ সবচেয়ে বড়।
উহুদের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সাহাবায়ে কিরাম সমস্বরে আল্লাহর নামে স্লোগান দেন। ইথারে ইথারে মহান প্রতিপালকের বড়ত্বের আওয়াজ ছড়িয়ে দেন।
(সহিহ বুখারি-৩০৩৯)
আল্লাহু আকবার। মানে আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আকাশে জমিনে তিনিই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।
আল্লাহু আকবারের পবিত্র আওয়াজ মুমিন হৃদয়ে প্রশান্তির দোলা দিয়ে যায়। দেহমনে স্নিগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে দেয়। আল্লাহু আকবার নেতিয়ে পড়া ইমানে চেতনা জাগিয়ে তোলে। যে চেতনা জীবনজুড়ে ইমানের পথে এগিয়ে যেতে মুমিনকে প্রেরণা জোগায়। আল্লাহু আকবার তথা তাকবির বলা কোরআনের উজ্জ্বল নির্দেশনাবলির অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তুমি তোমার প্রতিপালকের বড়ত্বের ঘোষণা দাও। মানে আল্লাহু আকবার বলো।’ (সুরা মুদ্দাসিসর-৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ যে তোমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন সেজন্য তার বড়ত্বের জয়গান গাও তথা আল্লাহু আকবার বলো। (সুরা বাকারা-১৮৫)
আল্লাহু আকবারের পবিত্র আওয়াজ মুমিনকে পরিশুদ্ধ করে। পাপের পঙ্কিলতা থেকে ধুয়েমুছে জীবনকে করে তোলে স্বচ্ছ, সুনির্মল।
হজরত আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি শুকনা পাতাওয়ালা গাছের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর লাঠি দিয়ে তাতে আঘাত করলে হঠাৎ পাতাগুলো ঝরে পড়ে। অতঃপর তিনি বললেন কোন বান্দা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ‘সুবহানাল্লাহ’ এবং ‘লাইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ (সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার আল্লাহতায়ালা অতি পবিত্র এবং আল্লাহতায়ালা ব্যতীত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি অতি মহান) বললে তা তার গুনাহ এরূপভাবে ঝরিয়ে দেয় যেভাবে এ গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়েছে। (জামে তিরমিজি, হাদিস নং-৩৫৩৩)। আল্লাহু আকবারের পবিত্র উচ্চারণ আমলের পাতাকে নেকি আর সওয়াব দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেয়। যে সওয়াব উহুদ পাহাড়কেও ছাড়িয়ে যায়। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহু আকবারের সওয়াব উহুদ পাহাড়ের চেয়েও বেশি। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব-১৫৪০)
আল্লাহু আকবারের পবিত্র আওয়াজ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয়াবলির অন্যতম।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমি বলি- ‘সুবহা-নাল্ল-হি ওয়াল হামদু লিল্লা-হি ওয়ালা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াল্লাহু আকবার।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর পবিত্র, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর এবং আল্লাহ ভিন্ন কোনো মাবুদ নেই, আল্লাহ মহান’ পড়া আমার কাছে বেশি প্রিয় সেসব বিষয়ের চেয়ে, যার ওপর সূর্য উদিত হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৭৪০)। তাই আসুন আমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহু আকবার বলি। আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দিই। ইথারে ইথারে ছড়িয়ে দিই মহান প্রতিপালকের মর্যাদাময় পবিত্র সে আওয়াজ। তাকবিরের পবিত্র আওয়াজে আমাদের ঘুমন্ত হৃদয়ে চেতনার ঢেউ তুলি।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর