আন্তর্জাতিক আর্থিক অঙ্গনে ডলারের আধিপত্য কমে যাওয়ার বিষয়টি এখন অদ্ভুত মোড় নিয়েছে। একদিকে ডলারের বিকল্প খুঁজতে থাকা উদীয়মান ব্রিকস জোট, আর অন্যদিকে এই প্রক্রিয়া আটকাতে চাওয়া যুক্তরাষ্ট্র; দুই পক্ষই অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় একই ধরনের কাহিনি শোনাচ্ছে। ডলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মূল কারণ নাকি ওয়াশিংটনের মুদ্রার অস্ত্রায়ন বা জবরদস্তি ব্যবহার।
২০২২ সালে রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাই সেই মুহূর্ত, তখন ওয়াশিংটন বৈশ্বিক ডলার ব্যবস্থার 'হিতৈষী তত্ত্বাবধায়ক'-এর ভূমিকা ছেড়ে একে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। নিঃসন্দেহে, ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু, সত্যিই কি এই একটি কারণের জন্যই দেশগুলো ডলারের বিকল্প খুঁজতে এত ব্যস্ত?
এর পেছনের ধারণা হলো, যেকোনো দেশই ওয়াশিংটনের ইচ্ছামতো রোষের শিকার হতে পারে। তবে, কজনই বা প্রশ্ন করে চীনের মতো একটি কেন্দ্রীয় অর্থনীতি কি সত্যিই রাশিয়ার মতো নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে আছে?
আসলে ডলার-বিমুখতার আসল চালিকাশক্তি হলো অর্থনৈতিক। আমেরিকার ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝার কারণে দেশটিকে কাঠামোগতভাবে নেতিবাচক প্রকৃত সুদের হার বজায় রাখতে হবে। রিজার্ভ ধারণকারী দেশগুলোর জন্য এর অর্থ হলো সময়ের সাথে সাথে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পাবে। এই অর্থে, ডলার-বিমুখতা কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয় বরং বিনিয়োগের সিদ্ধান্তও। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার অনেক আগেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং তা অব্যাহত থাকত।
২০১৪ সাল থেকেই বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিট ভিত্তিতে আর মার্কিন ট্রেজারি কিনছে না, অথচ আমেরিকার ঘাটতি বেড়েই চলেছে। ২০২০-২০২২ সময়কালে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ঋণ ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা যুদ্ধকালীন সময় ছাড়া ছিল নজিরবিহীন। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটনের হাতে আর্থিক স্থায়িত্বের কোনো বিশ্বাসযোগ্য পথ নেই। ঋণভার লাঘবের জন্য সময়ের সাথে সাথে তাদের নেতিবাচক প্রকৃত সুদের হার চালাতেই হবে। এটা ডলারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। বিশ্লেষক লুক গ্রোম্যান একে জাতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার সাথে তুলনা করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে, ওয়াশিংটন ডলারের অর্থনৈতিক দুর্বলতা স্বীকার করার পরিবর্তে ডলারের অস্ত্রায়নের ফলে হওয়া কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করাকে শ্রেয় মনে করে। মার্কিন অর্থনীতি জ্যানেট ইয়েলেন এপ্রিল ২০২৩-এ স্বীকার করেছিলেন, আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ব্যবহারের ফলে ডলারের আধিপত্য দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি আছে। তাদের ভাষ্যমতে, এটি কেবল একটি ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ারের ক্রমাঙ্কন, যাতে বিশ্বের বাকি অংশ তাদের বিনিয়োগের রিটার্ন সংরক্ষণের জন্য বন্য ধারণা না পায়।
অন্যদিকে, ব্রিকস দেশগুলোও অর্থনৈতিক দুর্বলতার দিকটি নিয়ে জনসমক্ষে খুব বেশি সরব হতে চায় না। কারণ, তারা এখনও বিপুল পরিমাণ ডলার সম্পদ ধারণ করে আছে। যদি তারা প্রকাশ্যে মার্কিন ঋণের দেউলিয়াত্বের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে, তবে তাদের নিজস্ব পোর্টফোলিওতে থাকা বন্ডগুলোর মান রাতারাতি কমে যাবে।
তাই ব্রিকস দেশগুলো নীরবে স্বর্ণ কিনছে (যা এখন দ্রুততম বর্ধনশীল আন্তর্জাতিক রিজার্ভ সম্পদ), ডলার-বহির্ভূত দ্বিপাক্ষিক লেনদেন বাড়াচ্ছে এবং নতুন আর্থিক অবকাঠামো তৈরি করছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা বৈচিত্র্যকরণের মতো মৃদু বক্তব্যই দেয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ওয়াশিংটন এবং ব্রিকস দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ভূ-রাজনৈতিক ব্লকই ডলার-বিমুখতার কারণ হিসেবে ভূ-রাজনীতি এবং নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ডলারের অর্থনৈতিক ভিত্তি ক্ষয় হওয়ার মৌলিক আর্থিক যুক্তিকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
দু'পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে একই গল্প বললেও এর মধ্যে পার্থক্য আছে। সম্ভবত ওয়াশিংটন ডিসির নীতিনির্ধারকরা তাদের নিজেদের প্রোপাগান্ডা সত্যিই বিশ্বাস করেন, অথচ ব্রিকস নেতারা প্রকৃত পরিস্থিতি পুরোপুরি জানেন এবং ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সতর্কতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল