নবান্নের উৎসবকে ঘিরে বগুড়ার শিবগঞ্জে উথলি গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো কোটি টাকার মাছের মেলা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই মাছ কেনাবেচা ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। শ্বশুর–জামাইয়ের কেনাকাটার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে এ মেলায় ৪০ গ্রামের মানুষ অংশ নেন।
মেলার মাছ ব্যবসায়িরা বলছেন একদিনের এই মেলায় কোটি টাকার ওপরে মাছ বিক্রি হয়ে থাকে।
জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের পঞ্জিকা অনুসারে নবান্ন উৎসব পালন করেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি গ্রামে কবে কখন থেকে এই নবান্নের মেলা চলে আসছে তার সঠিক ইতিহাস জানা নেই স্থানীয় প্রবীনদের। তবে তাদের ধারণা মতে প্রাচীন করতোয়া নদীর পাড়ে প্রায় আড়াইশত বছর আগে থেকে এই মেলা হয়ে আসছে।
মেলা উপলক্ষে উথলি ছাড়াও আশপাশের ছোট নারায়নপুর, বড় নারায়নপুর, রথবাড়ি, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদনীপাড়া, বাকশন, রহবল, আকন্দপাড়া, জাবাড়িপুর, ছয়ঘড়িয়া, পাইকপাড়াসহ আশপাশের অন্তত ৪০টি গ্রামে বিরাজ করে অন্য রকম উৎসবের আমেজ।
নবান্নকে ঘিরে জেলার শিবগঞ্জ ছাড়াও নন্দীগ্রাম ও কাহালু উপজেলায় বসে মাছের মেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের দিন হলেও এই দুই উপজেলায় প্রায় সকল ধর্মের মানুষ মাছ মেলা থেকে কেনাকাটা করে থাকেন। মূলত শিবগঞ্জের এই মেলায় শ্বশুড় ও জামাইয়ের সবচেয়ে বড় মাছ কেনার লড়াই হয়ে থাকে। কোন জামাই বা শ্বশুড় কত বড় মাছ কিনেছে তার প্রশংসা ও চর্চা হয় গ্রামজুড়ে। বড় মাছ ক্রেতা জামাই বা শ্বশুড়ের মান বাড়ে ভিন্নরকম। বড় মাছ কেনার এই প্রতিযোগিতায় প্রায় সকলেই অংশগ্রহণ করে থাকেন।
নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই মেলায় ভোর থেকেই ভিড় জমতে থাকে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। হাসি, আনন্দ আর কেনাবেচার কোলাহলে পুরো এলাকা পরিণত হয় উৎসবমুখর জনসমুদ্রে। এই মেলা এখন লোকজ সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। মেলায় এ বছর দেখা গেছে ৫ থেকে ২৫ কেজির রুই, কাতলা, বোয়াল, গ্লাসকার্প, সিলভারকাপ, চিতল, মৃগেল, ইলিশ, কার্পিও মাছ বিক্রি হয়েছে। এবার ছোট মাছও দেখা গেছে। মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো হরেক রকম মাছ।
৩০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা কেজি দরে মাছ বিক্রি হয়েছে। ২৫ কেজির বোয়াল ১৪০০ টাকা কেজি আর ১৮ কেজির সিলভার কাপ মাছ বিক্রি হয়েছে ১২০০ টাকা কেজি। এসব মাছ রাজশাহী, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এনেছেন পাইকাররা।
একদিনের এই মেলায় বিল ও নদীর মাছের পাশাপাশি পুকুরে চাষকৃত মাছও বিক্রি হয়। বছর জুড়ে বড় প্রজাতির মাছ এই মেলায় তুলে বিক্রি করেন মাছ চাষিরা। মাছ ছাড়াও নতুন আলু, শাকসবজি, কেশুর আলু ও পানিফল নবান্ন মেলার অন্যতম অনুষঙ্গ। মাছ মেলায় এসব সবজির পসরাও সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। এ মেলায় প্রতি কেজি নতুন আলু ৫০০ আর ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। সবজি ছাড়াও মিষ্টি, দই, চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, কদমা, বাতাসা, নিমকি, জিলাপি, আচারসহ হরেক রকম দোকান ঠাঁই পেয়েছে। শিশুদের খেলনা ও নারীদের জন্য কসমেটিকসের দোকানও আছে। সবার বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলার ব্যবস্থাও।
মেলার মাছ কিনতে আসা মো. জলিল উদ্দিন জানান, তিনি ১২ কেজির একটি রুই মাছ কিনেছেন। দর দাম করে নিয়েছেন ৯০০ টাকা কেজি।
স্থানীয় রহবল গ্রামে বিয়ে করার কারণে তিনি কয়েক বছর ধরেই এই মেলায় মাছ কিনে থাকেন। তিনি জানান, যতবড় মাছ কিনা হবে ততটায় তার চর্চা হয় এলাকায়। এই কেনাটাও একটা আনন্দ।
মেলার মাছ বিক্রেতা আল আমিন জানান, নবান্ন উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন মাছের খামার থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়। আগের দিন থেকে আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে ৩ শতাধিক মাছ বিক্রেতা পসরা সাজিয়েছেন। প্রতি বিক্রেতা কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ মন করে মাছ বিক্রি করবেন। খামারে মাছে আছে প্রচুর। বড় মাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। এই মেলায় সবচেয়ে বেশি কিনে থাকেন জামাইরা। ৪০০ থেকে ২০০০ টাকা কেজি দরে মাছ বিক্রি হচ্ছে।
তিনি দুপুর পর্যন্ত ছোটবড় মিলিয়ে ১৯ মন মাছ বিক্রি করেছেন। গড়ে ৫০০ টাকা মন হলে তিনি একায় প্রায় ৩ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।
মাছের ব্যাপারী আব্দুল হামিদ জানান, ভোর থেকে মেলা শুরু হয়। দিনব্যাপী মেলা চলে। মেলায় মাছের পাশাপাশি সকল ধরণের খাবার ও তৈজসপত্রও কেনাবেচা হয়। তিনি শিবগঞ্জের উথলী বাজারে পুকুরে চাষকৃত খামারিদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকার মাছ কিনেছেন। মাছ বিক্রি করে তিনি টাকা পরিশোধ করবেন। তিনি ৫ থেকে ৭ কেজির পাঙাশ ৩০০ টাকা কেজি আর ৭ থেকে ১০ কেজির রুই বিক্রি মাছ বিক্রি করছেন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মেলা আয়োজক কমিটির পক্ষে থেকে দাবি করা হয়েছে কোটি টাকার ওপরে এই মেলায় মাছ বিক্রি হয়েছে। এই মেলাটি এই এলাকার সবচেয়ে বড়মেলা। হাজারো মানুষের সমাগম হয়। যেমন মাছ কেনা ও বিক্রির ধুম পড়ে তেমনি প্রতি ঘরে ঘরে খাবারের ধুমও পড়ে যায়।
বিডি-প্রতিদিন/আশফাক