ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনে বিভিন্ন পর্যায়ে শুরু হয়েছে রবদবল। কোথাও নতুন করে পদায়ন হচ্ছে, কাউকে বর্তমান পদ থেকে অনত্র বদলি করা হচ্ছে। কাউকে নিয়োগ দিয়ে সে নিয়োগ বাতিলও করা হচ্ছে। নিয়োগ-বদলির নানানরকম কার্যক্রম নিয়ে অস্থিরতা রয়েছে প্রশাসনে। ফলে কাজের ক্ষেত্রে কেউ স্বস্তি পাচ্ছে না। চেয়ারে টিকে থাকা নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। কার কখন বদলি হয়, আবার বদলি হলে যোগদান করতে পারবেন কি না, সে নিয়ে থাকছেন আতঙ্কে। জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিয়োগ-বদলি একটি নিয়মিত কাজের অংশ, তবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন না। কর্মকর্তারাও জনপ্রশাসনের ডেস্ক কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্টদের আস্থায় নিতে পারছেন না। এসব বিভিন্ন কারণে সমালোচনা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এরই মধ্যে ৫০ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার। নিয়োগ পাওয়া ডিসিরা কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। নানান সমালোচনার কারণে দুজনকে ডিসি নিয়োগ দিয়েও বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া এক মাস আগে ডিসি নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিকেও সমালোচনার কারণে পদ থেকে সরানো হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার আগে কেন সঠিক যাচাইবাছাই করা হচ্ছে না। নিয়োগের পর বাতিল করে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা কেন ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। কর্মদক্ষতার চেয়ে গত সরকারের সময় কতটা বঞ্চিত ছিলেন, ডিসি নিয়োগে এসব বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি ভূমিতে কতটা দক্ষ, ম্যাজিস্ট্রেসি কতটা জানেন তা অনেকের ক্ষেত্রে মানা হয়নি বলে বিতর্ক উঠেছে। শুধু ডিসি পদেই নয়, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিবদের বিষয়ে আদেশ জারির পর তা সংশোধন করা হচ্ছে। আবার অনেকের আদেশ জারি হলেও বদলি কর্মস্থলে না গিয়ে তদবির করে আগের কর্মস্থলেই থাকছেন। জনপ্রশাসন থেকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ দিয়ে আদেশ জারি করেও কাজ হচ্ছে না। এসব স্ট্যান্ড রিলিজ ঠেকাতে নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিব বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে তদবির করিয়ে নিজের কর্মস্থলে ঘাঁটি গেড়ে আছেন বহু কর্মকর্তা।
জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্তরে রদবদল হতে পারে, সে কারণে প্রতিনিয়ত জনপ্রশাসনে ঘুরছেন কর্মকর্তারা। কেউ নিজের বর্তমান অবস্থানে আরও কিছু দিন থাকার জন্য জনপ্রশাসনে ঘুরছেন। মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ইউএনও-এসিল্যান্ডরাও চিন্তিত তাঁদের রদবদল হলে কোথায় পাঠাবে। বর্তমান কর্মস্থল থেকে সেটি কত কাছে বা দূরে হবে। জেলা বা বিভাগের মধ্যে পরিবর্তন করবে নাকি অন্য বিভাগে পাঠিয়ে দেবে, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেক মাঠের কর্মকর্তা। তবে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা আগত কর্মকর্তাদের বলে দিচ্ছেন, নির্দেশনা ছাড়া এ মুহূর্তে মাঠ পর্যায়ে হাত দেওয়া হবে না। নির্দেশ পেলে সে মোতাবেক কাজ করবে জনপ্রশাসন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা যুগ্মসচিব-উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা খোঁজ রাখছেন তাঁদের সরানো হবে কি না। যদি সরানো হয় তবে একটু খেয়াল যেন রাখেন, সে অনুরোধ জানিয়ে রাখছেন। কেউ বলে যাচ্ছেন, মাত্র ছয় মাস বা এক বছর ধরে আছি, এখন যেন অন্য কোথাও বদলি না করে। জনপ্রশাসনের ঊনি অধিশাখায় কর্মকর্তার ভিড় লেগেই থাকছে। এদিকে সম্প্রতি আবার বিভিন্ন ব্যাচের ‘দলীয় লেবাস’ ধারণ করে কিছু কর্মকর্তার রদবদলে খবরদারি বেড়েছে। যাকে তাকে দোসর তকমা দিয়ে ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া থেকে বিরত রাখতে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। এতে অনেক মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে ভালো কর্মকর্তার চেয়ে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের আধিপত্য বাড়ছে। আর মন্ত্রণালয়গুলোতে কাজের ক্ষেত্রে বাড়ছে স্থবিরতা। জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাচের অভিযোগ শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। সবাই একে অন্যের দোষারোপ করতে আসেন। ব্যাচের কর্মকর্তারা তার ব্যাচমেটদের দমিয়ে রাখতে আসেন। কেউ আসেন বিগত দিনে কার কার সঙ্গে ছবি আছে এসব দেখাতে।’
স্বরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বলেন, যারা ভালো কর্মকর্তা, কাজের কর্মকর্তা তাদের নামে একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে যায় সব সরকারের আমলেই। এতে ভালো কর্মকর্তাদের দূরে রাখতে পারলে অকর্ম্যদের সুবিধে হয়। এতে দিন শেষে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। গত কয়েক দিন জনপ্রশাসনে দেখা গেছে, প্রতিদিনই কর্মকর্তারা আসছেন রদবদলের খোঁজ নিতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক কর্মকর্তাকে হুটহাট বদলি করে ফেলা হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে একটা দুশ্চিন্তা কখন যেন বদলি হয়। যাদের লম্বা সময় হয়েছে তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেশি। রদবদলের পাশাপাশি পদোন্নতি নিয়েও হতাশা রয়েছে প্রশাসনে। প্রশাসনের ২৪ ব্যাচের যুগ্মসচিব হতে না পারা কর্মকর্তারা আর ৩০ ব্যাচের উপসচিব হতে না পারা কর্মকর্তারা পদোন্নতির আশায় আছেন। নিয়মিত ব্যাচ ২০-এর কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব করা হচ্ছে না এখনো, এ নিয়েও অস্বস্তিতে আছেন কর্মকর্তারা। ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিবের চেয়ারে চার বছর ধরে কাজ করছেন। এতে অনেকটাই একঘেয়েমি চলে আসছে, কাজে প্রাণ হারিয়ে ফেলছেন বলেও জানান একাধিক কর্মকর্তা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রদবদল নিয়ে অস্থিরতা রয়েছে মাঠ প্রশাসনে। বর্তমানে ৩৪, ৩৫ এবং ৩৬ ব্যাচের কর্মকর্তারা ইউএনও। অনেকেই সন্তানদের নিজ কর্ম এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছেন। অনেকের স্বামী বা স্ত্রী একই জেলায় কর্মরত। রদবদলের প্রভাব নিয়ে এখনই নানান দুশ্চিন্তায় ইউএনওরা। যাঁরা দুই বছর বা কাছাকাছি হয়েছেন, তাঁরা বেশি চিন্তিত। ইউএনওদের মধ্যে কাদের মাঠ থেকে তুলে আনা হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে নতুন করে কাদের মাঠে দেওয়া হবে সে বিষয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানা গেছে। তবে একাধিক সূত্র জানান, মাঠ থেকে দুই বছরের ইউএনওদের একেবারে প্রত্যাহার করা হবে। একই সঙ্গে বেশির ভাগ ইউএনওর উপজেলা পরিবর্তন হবে। ৩৭ ব্যাচকে কবে ইউএনও হিসেবে মাঠে পাঠানো হচ্ছে, সে খবর নিতে জনপ্রশাসনে যোগাযোগ রাখছেন অনেকে। মাঠ প্রশাসনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) যাঁরা আছেন তাঁদেরও অনেকের জেলা পরিবর্তন হবে। ইতোমধ্যে মাঠে দায়িত্ব পালন করা এডিসিরাও খোঁজ রাখছেন তাঁদের রদবদল নিয়ে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অতীতেও নির্বাচনের আগে রদবদল হতো, তবে সমালোচনা বা এত অভিযোগ উঠত না। এখন যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁরা সামলাতে পারছেন না দক্ষতার সঙ্গে। তাঁরা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারতেন।’ সাবেক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রশাসন যত স্থির হবে, সরকারের জন্য ততই মঙ্গল। কারও কানকথা না শুনে ভালো কর্মকর্তাদের ভালো জায়গায় পদায়ন জরুরি।’