ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স), ইউনিয়ন পে-সহ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর কর পরিশোধ করেনি। কারণ এসব নেটওয়ার্ক দেশে নিবন্ধিত কোম্পানি নয়, তারা শুধু লিয়াজোঁ অফিস বা প্রতিনিধি কার্যালয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফলে তাদের আয় স্থানীয় আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায় না এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর কাঠামোর আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
এ পরিস্থিতি দূর করে কর আদায় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) রেগুলেশন-২০২৫ এর খসড়া তৈরি করেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হলে বিদেশি পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলোকে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ অনুযায়ী দেশি কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে। বিধিমালা কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আইনের খসড়ায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলো ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ইন্টারচেঞ্জ রিইমবারসমেন্ট ফি-সহ (আইআরএফ) বিভিন্ন চার্জবাবদ বছরে ২০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আদায় করে, কিন্তু এসব অর্থ দেশের বাইরে রাখা নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের বৈশ্বিক সদরদপ্তরে পাঠানো হয়। ফলে বাংলাদেশে প্রদেয় কর এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। সেবাগুলো বাংলাদেশে ব্যবহৃত হলেও আয় হিসাব করা হচ্ছে বিদেশে। এতে নিয়ন্ত্রণ ও কর উভয় ক্ষেত্রেই ফারাক তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে আন্তর্জাতিক একটি কার্ড নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিরা শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার পাশাপাশি নানাভাবে বিরোধিতা করে আসছেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের লেনদেনের পরিমাণ তুলনামূলক কম হওয়ায় কঠোর বাধ্যবাধকতা বৈশ্বিক অপারেটরদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। বড় নেটওয়ার্কগুলো সরে গেলে ভোক্তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তারা মতামত দেন। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা সব সময় উপেক্ষা করছে। বাংলাদেশে যাত্রার শুরুর পর থেকে কি পরিমাণ গ্রাহকের কার্ডে কত টাকার লেনদেন হয়েছে তার কোনো তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই। সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সব ধরনের লেনদেনের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিলেও ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস কখনোই তা জমা দেয়নি।
অর্থ পাচার, সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার লেনদেনের হিসাব চাইলেও তাতে কর্ণপাত করে না আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কার্ডের মাধ্যমে দেশের লেনদেনের সঠিক চিত্র তুলে ধরা এবং সঠিক প্লাটফর্ম ব্যবহার হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ ও নীতিনির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে লেনদেনের সঠিক চিত্র তুলে ধরা এবং সহজেই মনিটরিং করা যাবে। এ ছাড়া নতুন বিধিমালা কার্যকর হলে আন্তর্জাতিক কার্ড প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশে ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে, বাংলাদেশে লেনদেন থেকে অর্জিত আয়ের হিসাব জমা দিতে হবে এবং কর্পোরেট কর পরিশোধ করতে হবে।
ব্যাংকাররা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, কর আদায়ের পাশাপাশি স্বচ্ছতার জন্য আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা উচিত। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের স্বার্থ অবশ্যই বড় বিষয়। তবে বিধিমালা কার্যকর করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কার্ডে লেনদেন দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে রয়েছে চার কোটি ৪৯ লাখ ডেবিট কার্ড, ৩০ লাখ ৮ হাজার ক্রেডিট কার্ড এবং ৯৯ লাখ ৯৪ হাজার প্রিপেইড কার্ড। আন্তর্জাতিক লেনদেনে এখনো ভিসা ও মাস্টারকার্ডই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এরপর আমেরিকান এক্সপ্রেস, ইউনিয়ন পে, ডাইনার্স ক্লাব ও জেসিবি।