বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বলবেন, চাঁদাবাজি। বিভক্ত এই দেশে সব বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। কেউ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায়, কেউ চায় না। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত, চাঁদাবাজিমুক্ত একটা দেশ চায় সবাই। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলেন সবাই-রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ মানুষ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কেউ পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী নন। সাধারণ মানুষ চাঁদাবাজদের কাছে অসহায়। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়। রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, প্রকাশ্যে অথবা গোপনে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে চাঁদাবাজরা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি গোটা দেশের মানুষ। তবে এ ভয়ংকর ব্যাধিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ব্যবসায়ীরা। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা, কেউই চাঁদাবাজদের থেকে নিরাপদ নন। গত দেড় বছরে এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক, এর সঙ্গে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য ব্যবসাবাণিজ্য অসম্ভব করে তুলেছে। চাঁদাবাজদের কাছে অসহায় সর্বস্তরের ব্যবসায়ী আর্তনাদ করছেন। তাঁরা বলছেন, আগে চাঁদা দিতে হতো এক জায়গায়, এখন দিতে হয় দশ জায়গায়। দেশে সব সময় ব্যবসাবাণিজ্যে নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়ে থাকে ব্যবসায়ী মহলে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হলেও সে আশার গুড়ে বালিই পড়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা না আসায় ব্যবসাবাণিজ্য এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য বিষফোড়া হিসেবে চাঁদাবাজি ব্যবসায়ীদের চরমভাবে ভুক্তভোগী করছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন বা এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় বলা হয়, পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে খালাস পর্যন্ত চলমান ভয়াবহ চাঁদাবাজি। ব্যবসায়ী নেতারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নিত্যপণ্য পরিবহন ও সরবরাহের পথে গুরুতরভাবে চাঁদাবাজি চলছে। পণ্য ট্রাকে ওঠানো-নামানো সর্বত্রই চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও চাঁদাবাজদের ‘দহরম-মহরম’ থাকার অভিযোগ নতুন নয়। চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ তৈরি না হলে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে না এবং বাজার স্থিতিশীল হবে না-এ কঠোর সত্যটি সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক কেবল ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে অনুরোধ করা হবে’ বলে দায় সারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না, দরকার কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন নিত্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেতা। রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য এ মতবিনিময় সভা করেছে সংগঠনটি। মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনের মিলনায়তনে ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআইয়ে নিযুক্ত প্রশাসক মো. আবদুর রহিম খান।
ব্যবসায়ীরা বছরজুড়েই চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি। কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা শামসুল হক মণি বলছিলেন, প্রতিদিন তাঁকে অন্তত ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে বন্ধ হয়ে যাবে তাঁর দোকান। হিসাব করে দেখালেন দিনে আয় হয় দেড় হাজার টাকা। তাঁর আকুতি, উপার্জনের তিন ভাগের এক ভাগ যদি দিতে হয় তাহলে চলবেন কীভাবে? চাঁদাবাজদের টাকা দিতে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই ক্ষুদ্র দোকানি। এ রকম চিত্র দেশের সব ফুটপাতের দোকান, কাঁচাবাজারে। মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করেন আমিনুল। বললেন কীভাবে চাঁদাবাজদের জন্য তিনি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর কিছু তরুণ তাঁর মতিঝিল অফিসে যান। ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তারা। না দিলে হত্যা মামলার হুমকি দেন। ২০ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়া তাঁর জন্য ছিল অসম্ভব। চাঁদা দিতে না পারায় তিন দিন পর গত বছরের ডিসেম্বরে আমিনুলের মতিঝিল অফিসে হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। আমিনুল থানায় যান। থানা সাফ জানিয়ে দেয়, তাদের কিছু করার নেই। এখন অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন আমিনুল। এ রকম ঘটনা অসংখ্য। বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৫ মাসে ২৭৮টি শিল্পকারখানা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চাঁদাবাজদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ৬৮ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয় চাঁদাবাজরা। আর নীরব চাঁদাবাজির কথা তো সবাই জানেন। একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলছিলেন, এখন কোনো ব্যবসায়ী চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। কারণ মুখ খুললেই বিপদ। এভাবেই চলছে ব্যবসা অঙ্গনে সর্বব্যাপী চাঁদাবাজি। সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন নীরব দর্শক। সরকার এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। অসহায় দেশের মানুষ। চাঁদাবাজির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। শুধু ব্যবসায়ী কেন, চাঁদাবাজির থাবা থেকে মুক্ত নয় কেউ।
মোহাম্মদপুরের একজন গৃহিণী বলেছিলেন, এখন প্রতি মাসে বাড়িভাড়ার মতো কিশোর গ্যাংদের চাঁদা দিতে হয়। তাঁর দাবি, গোটা মোহাম্মদপুরে এখন এই নিয়ম। যদি কেউ চাঁদা না দেয় তাহলে তাঁর জীবন নরক বানিয়ে দেওয়া হয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কিশোর গ্যাংদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে হয়রানির শিকার হন। এখন মোহাম্মদপুরবাসী এটাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। একজন বললেন, বিষয়টা পুলিশকে জানালেও বিপদ।
সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি আগেও ছিল, এখন শুধু হাতবদল হয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ও মালিক সমিতির নেতৃত্ব বদল হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব চাঁদার রেট বাডিয়ে দিয়েছে। আর পথে পথে পুলিশের চাঁদাবাজি তো আছেই। এখন আবার যুক্ত হয়েছে এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি।
স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাও চাঁদাবাজির আওতামুক্ত নয়। কুমিল্লায় একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে তাঁকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়। ওই শিক্ষক প্রথমে পাত্তা দেননি। কিন্তু দুই দিনের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে অপমানজনকভাবে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। স্কুলের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মতে এই শিক্ষক কোনো দিনই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বৈরাচারের দোসর খোঁজার নামে যে মব সন্ত্রাস চলছে তার নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি। এভাবেই সব ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি চলছে বাধাহীনভাবে। অসহায় দেশের মানুষ।