১৯৭৯ সাল, অভিনেত্রী শাবানা যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসায়ী স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করবেন। ছবির পরিচালক ঠিক করলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক আজিজুর রহমানকে এবং নায়ক হিসেবে বেছে নিলেন নায়করাজ রাজ্জাককে, যিনি শাবানার বিপরীতে অভিনয় করবেন। এই ছবির জন্য নায়করাজ রাজ্জাক কোনো পারিশ্রমিক নেননি। কারণ শাবানা যখন রাজ্জাককে জানালেন, তিনি ছবি প্রযোজনা করতে যাচ্ছেন তখন রাজ্জাক এতটাই উচ্ছ্বসিত হলেন যে, তিনি ছবির গল্প না শুনেই এতে অভিনয় করতে রাজি হয়ে গেলেন এবং শাবানাকে বললেন, তোমার এই ছবির জন্য আমি এক টাকাও পারিশ্রমিক নেব না। ছবির মহরতও করলেন, শুটিংও শুরু হলো। কিন্তু মাঝপথে টাকার জন্য ছবির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। নিজের সঞ্চিত টাকা ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার করে যতটুকু সম্ভব কাজ চালিয়ে গেলেন কিন্তু তবুও থেমে যেতে হলো। ছবি মুক্তি নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেলেন। অবশেষে এগিয়ে এলেন হানিফ পরিবহনের কর্ণধার যিনি শাবানার প্রযোজিত প্রথম ছবিটিতে লগ্নি করলেন বা শাবানাকে টাকা ধার দিলেন। এভাবেই সেদিন আজিজুর রহমানকে দিয়ে শাবানা ও তাঁর স্বামীর প্রযোজিত যে ছবিটি নির্মাণ করলেন তার নাম ‘মাটির ঘর’ যা মুক্তি পাওয়ার পর দর্শক হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ‘মাটির ঘর’ হয়ে গেল সুপারহিট আর বাংলা চলচ্চিত্র শাবানার হাত ধরে পেল ‘এসএস প্রোডাকশনস’-এর মতো একটি সফল প্রযোজনা সংস্থা। যে সংস্থাটি আমাদের উপহার দিয়েছিল ‘নাজমা’, ‘লাল কাজল’, ‘অশান্তি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘স্বামী স্ত্রী’, ‘রাঙাভাবী’, ‘গরীবের বউ’, ‘অন্ধ বিশ্বাস’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘অগ্নিসাক্ষর’-এর মতো আরও অসংখ্য দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের কত শত চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। তবুও কিছু চলচ্চিত্র সিনেমা হলে না দেখতে পারার দুঃখ দর্শককে তাড়িয়ে বেড়ায় যার একটি হলো ‘মাটির ঘর’। এসএস প্রোডাকশনসের প্রথম প্রযোজিত ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি ছিল তৎকালীন গ্রামীণ পটভূমির ওপর নির্মিত দুই তরুণ-তরুণীর একটি হৃদয়বিদারক প্রেম কাহিনি। ছবির শেষে গিয়ে দর্শক নামের সার্থক-মর্মার্থ খুঁজে পেয়েছিল। দর্শকদের কাছে আজও ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি স্মরণীয় হয়ে আছে। দর্শকের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা, সত্য সাহার সুরে সুবীর নন্দী ও শাম্মীর আক্তারের কণ্ঠে গাওয়া এই ছবির গান ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ১৬ আনা’। ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি দেখে কাঁদেনি এমন কোনো দর্শক খুঁজে পাওয়া যায়নি। যারা হলে দেখেছিলেন তারা যেমন সিনেমা হল থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি যারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলেন তারাও কেঁদেছিলেন। ছবির শেষ দৃশ্যটি দর্শককে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল, মনে হয়েছে সিনেমার পরিণতিটি বোধহয় সত্যি। রাজ্জাক, শাবানা ও পরিচালক আজিজুর রহমান ত্রয়ীর পারিবারিক ও বিয়োগান্তক গল্পের ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি আজও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ক্লাসিক রোমান্টিক ছবি হয়ে আছে। এই ছবিতে রাজ্জাকের চরিত্রের নাম ছিল আলাউদ্দীন আর শাবানার নাম আমিনা। ছবিতে কৌতুক অভিনেতা টেলিসামাদের মুখের সংলাপ ‘দিদিগো মারা যাবো’ আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে।