‘খায়রুন লো, তোর লম্বা মাথার কেশ’, খায়রুন সুন্দরী ছবির এই গানটি আজও দর্শকদের মনে উন্মাদনা জাগায়। ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রটি পুরোপুরি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মাণ করেন এ কে সোহেল।
কথিত আছে, চল্লিশের দশকে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর গ্রামে আজগর মাস্টারের মেয়ে খায়রুনকে দেখেই প্রেমে পড়ে একই জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বরখালী গ্রামের বিড়ির ব্যবসায়ী ফজল হক। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়। পরবর্তীতে সুখের সংসারে আগুন লাগায় খায়রুনের ছোটভাই, মতান্তরে ফজল হকের বন্ধু। মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে খায়রুনকে হত্যা করতে গিয়ে ফজল প্রথমবার হত্যা করে ফেলে নিজ পুত্রকে। এতে ফজল ক্ষান্ত হননি, পরে আবারও সে খায়রুনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এবার সে ডাকাতদের সহায়তায় খায়রুনকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরের দিন নদীতে ভেসে ওঠে খায়রুনের লাশ। এক কান দুই কান হয়ে জানাজানি হয়ে যায় ফজলের হত্যার কথা। খায়রুনের লাশ শনাক্ত হয়, পড়শিরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। অবশেষে ফজল ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। তিনি কারাবন্দি হন। বেশ ক’বছর পর বিশেষ বিবেচনায় তিনি জেল থেকে মুক্তি পান এবং পরবর্তীতে তিনি আবার বিয়ে করেন।
এ কে সোহেল এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে ২০০৪ সালে ‘খায়রুন সুন্দরী’ ছবিটি নির্মাণ করেন। ছবিটি ও এর টাইটেল গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, মাত্র ৫০ লাখ টাকা বাজেটের এই ছবিটি তখন প্রায় ৬ কোটি টাকার ব্যবসা করে। ‘খায়রুন লো’ গানটির রচয়িতা ছিলেন প্রয়াত ওয়াদুদ রঙ্গিলা। আর এ গানে কণ্ঠ দেন মমতাজ। ছবিতে খায়রুনের ভূমিকায় মৌসুমী ও ফজলের চরিত্রে অভিনয় করেন ফেরদৌস। জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা দিলদারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ‘খায়রুন সুন্দরী’ মুক্তি পায়। জীবদ্দশায় তিনি তার অংশটুকু সম্পূর্ণ করে যেতে পারলেও এ চলচ্চিত্রের ডাবিং করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তার চরিত্রে কণ্ঠ দেন জনপ্রিয় ডাবিং শিল্পী আনোয়ার শাহী। ‘খায়রুন সুন্দরী’র তুমুল জনপ্রিয়তার পেছনে সব থেকে বড় অবদান হলো এর সংগীত অর্থাৎ গানগুলোর। ‘খায়রুন লো.. তোর লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ’ এই গান তৎকালীন সময়ে শুনে বিমোহিত হননি এমন শ্রোতা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। সে সময় এই চলচ্চিত্রের অ্যালবাম রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি হয়। ক্রেতার চাপ সামলাতে না পেরে অডিও প্রতিষ্ঠান চিত্রগীতি তাদের অ্যালবামের কভার ছাড়াই শুধু ডিভিডি আলাদাভাবে বিক্রি করে। ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ছিলেন ওয়াদুদ রঙ্গিলা ও এ কে সোহেল, সুরকার ছিলেন ইমন সাহা। ওয়াদুদ রঙ্গিলা ওই চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রের সব গানই মূলত জারি গান। আবহমান বাংলায় যুগ যুগ ধরে এই গানগুলোর সুর মানুষের মুখে মুখে ভিন্ন ভিন্ন কথায় ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলার এই প্রাচীন ঘরানার লোকগান এখনকার দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল ‘খায়রুন সুন্দরী’র মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পায় তখন পুরো দেশ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এ ছাড়া কম বাজেটে নির্মিত অশ্লীল চলচ্চিত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল সে সময়। এরকম পরিস্থিতিতে মুক্তি পেয়েও চলচ্চিত্রটি সে বছরের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হয়। ওই চলচ্চিত্রটি সফল হওয়ার পেছনে সিনেমা হলে উপস্থিত নারী দর্শকের ভূমিকা সব থেকে বেশি। প্রচুর সংখ্যক নারী দর্শকের ঢল ‘খায়রুন সুন্দরী’ পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায়নি। পরিচালক এ কে সোহেলের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মেঘালয় চলচ্চিত্র ‘খায়রুন সুন্দরী’ প্রযোজনা এবং পরিবেশন করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা চলচ্চিত্র এই চলচ্চিত্রটিকে ‘প্রাণের স্বামী’ নামে ভারতে বাংলা ভাষায় রিমেক করে। পরিচালক যথারীতি এ কে সোহেল। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে মূল চলচ্চিত্রের অভিনেতা ফেরদৌস ও এ টি এম শামসুজ্জামান অভিনয় করেন।