কবে শেষ হবে আমাদের এই ভোগান্তি? এভাবেই করুণ সুরে আক্ষেপ করছিলেন বিমা দাবিদার মোকলেসুর রহমান। শেখ হাসিনার আমলে টাকা না পাওয়ার পর ভেবেছিলেন, স্বৈরাচার পতনের পর হয়তো প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাবেন। কিন্তু এখন সেই আশাও ম্লান হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। মোকলেসুর রহমানের অভিযোগ, স্থানীয় অফিসে বহুবার ঘুরেও কোনো ফল হয়নি। তাদের কথামতো ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা বারবার নতুন তারিখ, কিন্তু টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) দ্বারস্থ হওয়ার পরও সমাধান মেলেনি।
রাজবাড়ী থেকে আসা মোকলেসুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভবিষ্যতের জন্য বিমা কোম্পানিতে টাকা রেখেছিলাম। তিন বছর আগে মেয়াদ শেষ হলেও এখনো টাকা পাইনি। অসহায় হয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন আশ্বাস শুনছি। এমন অভিজ্ঞতা এক মোকলেসুর রহমানের নয়, হাজার হাজার গ্রাহক বছরের পর বছর ঘুরেও নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
বিমা আইন ২০১০ অনুযায়ী, মেয়াদপূর্তির ৯০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর বিমা দাবি নিষ্পত্তির কথা। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। বছরের পর বছর ঘুরেও টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৬টি জীবন বিমা কোম্পানির মোট বকেয়া দাবির পরিমাণ ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫১টি। এসব দাবিতে আটকে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৪১৪ কোটি।
অন্যদিকে নন-লাইফ বিমা খাতে পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৬টি কোম্পানির মোট দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ২৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার দাবির বিপরীতে গ্রাহক পেয়েছেন ৯ টাকারও কম। সব মিলিয়ে জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা খাতে বকেয়া দাবির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে পরিবারতন্ত্র, ভুয়া সার্টিফিকেট, ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ, জাল-জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে তছরুপ, এসবের কারণে বিমা খাত ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীও এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। কোম্পানিগুলোর অপকর্ম দেখেও না দেখার ভান করা, কিংবা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রশ্রয় দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম হলেও সর্বোচ্চ জরিমানা হয় মাত্র কয়েক লাখ টাকা, যা কোম্পানিগুলোর জন্য কোনো শাস্তি নয় বরং অতি সামান্য ব্যয়।
এ বিষয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাকা না পেয়ে অনেক গ্রাহক আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। তবে আমরা সরাসরি টাকা দিতে পারি না। কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া, সর্বোচ্চ জরিমানা কিংবা লাইসেন্স বাতিল করার ক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু এতে গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ হয় না। তিনি আরও জানান, বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের মতামত নেওয়া হচ্ছে। মতামত পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।
আর্থিক খাতে সংস্কারের ছোঁয়া পড়লেও বিমা খাত এখনো থেকে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। অনিষ্পন্ন দাবির পাহাড় দিনদিন উঁচু হচ্ছে। ফলে গ্রাহকের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত কার্যকর সংস্কার না হলে হাজার হাজার গ্রাহক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুটপাটকারীদের হাতেই থেকে যাবে, আর বিমা খাত হয়ে উঠবে আস্থাহীন এক মরণফাঁদ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আদিবা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েকটি কোম্পানি দাবি নিষ্পত্তি করার জন্য সময় চেয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে একটি প্রস্তাব দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো আইডিআরএ যদি কোম্পানিগুলোকে তহবিল সহায়তা দেয়, তাহলে দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।