রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত শনিবার সকালে সারি সারি সবজির স্তূপ, বেগুন, টম্যাটো, বাঁধাকপি, লাউ, শসা, ঢ্যাঁড়শ। সরবরাহে ঘাটতি নেই, তবু দাম শুনলেই ক্রেতাদের কপালে ভাঁজ। বেগুন কেজি ৮০ টাকা, টম্যাটো ১০০ টাকার ওপরে, ফুলকপি একেকটি ৮০ টাকা। ক্রেতাদের প্রশ্ন যখন উৎপাদন বেড়েছে, তখন বাজারে দাম কেন কমছে না? অন্যদিকে মানিকগঞ্জের কৃষক আবদুল কাদের বললেন ভিন্ন কথা। আগে শুধু ধান চাষ করলেও এখন বেগুন, শসা, লাউ চাষে ঝুঁকছেন তিনি। কারণ, ধানের চেয়ে সবজিতে লাভ বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো, মাঝখানে দালাল আর পরিবহন খরচ আমাদের আসল মুনাফাটা খেয়ে ফেলে, বলে আক্ষেপ করলেন তিনি। উৎপাদনে রেকর্ড অগ্রগতি : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট সবজি উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯০ হাজার টন। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এটি ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। তালিকার শীর্ষে আছে চীন, দ্বিতীয় স্থানে ভারত। কেন বাড়ছে উৎপাদন : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, এই প্রবৃদ্ধি এসেছে মূলত উন্নতমানের বীজ, আধুনিক প্রযুক্তি, নীতিগত সহায়তা, হাইব্রিড বীজ ব্যবহার, বাড়ির আঙিনায় বাগান করা, অফ-সিজন ও সর্ব-মৌসুমি চাষাবাদের কারণে। কৃষি অর্থনীতিবিদ এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, সবজি এখন নগদ ফসল। বাজারে বাড়তি চাহিদা, পুনঃপুনঃ চাষাবাদ, উচ্চফলনশীল জাত ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করেছে। গবেষক ড. মুহাম্মদ শফিউল্লাহ এবং ড. ফরিদুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, সবজির চাহিদা বাড়ায় কৃষকরা ধানের তুলনায় বেশি মুনাফা পাচ্ছেন। এই লাভ কৃষকদের আরও বেশি করে সবজি চাষে আগ্রহী করছে। ভোক্তার ভোগান্তি যদিও উৎপাদন বেড়েছে, তবু বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, পরিবহন খরচ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি এর মূল কারণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ঢাকার মিরপুরের গৃহিণী রুবিনা বেগমের আক্ষেপ সব জায়গায় শুনি রেকর্ড উৎপাদনের খবর। কিন্তু আমাদের বাজার খরচ তো কমছে না, বরং বাড়ছেই।
প্রাচুর্য ও পুষ্টি : দেশে এখন প্রায় ১০০ ধরনের সবজি চাষ হয় প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমিতে। জনপ্রিয় সবজির মধ্যে আছে বেগুন, টম্যাটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, কুমড়া, ঢ্যাঁড়শ, শসা, মুলা, শিম, গাজর, পালং শাক, লালশাক, বরবটি, শজনে ও কচু। এসব সবজিতে ভিটামিন, খনিজ ও নানা পুষ্টিগুণ বিদ্যমান, যা ভাতনির্ভর খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য আনছে। রপ্তানি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ : সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়ছে প্রতিবছর। এতে কৃষকরা উৎসাহিত হচ্ছেন, তবে দেশের বাজারে সবজির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোক্তাকে সাশ্রয়ী দামে সবজি পৌঁছে দিতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এবং দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্রুততম সবজি উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি। কিন্তু এই সাফল্যের আসল পরীক্ষা হবে যখন প্রাচুর্যের সবজি ভোক্তার পাতে স্বস্তি নিয়ে পৌঁছাবে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবজির দাম নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। আড়তদার ও কমিশন এজেন্টদের একটি চক্র যোগসাজশে ইচ্ছেমতো সবজির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না, অন্যদিকে আমাদের শহরের মানুষকে ১০ গুণ বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। সার-বীজের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। কৃষকরা বছরের পর বছর ফসল ফলিয়ে মুখে হাসি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন না।’ নাজের হোসাইন আরও বলেন, ‘আগের তুলনায় পরিস্থিতি ও জটিলতা দুটোই বেড়েছে। আগে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট ও নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হতো। এখন সেগুলো প্রায় হয় না বললেই চলে। এক কথায়, সবজির দাম নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ে সরকারের উদ্যোগ স্পষ্টতই কম।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবজির ফলন নিঃসন্দেহে ভালো হচ্ছে, কিন্তু বাজারে এর দাম এখনো আকাশছোঁয়া। প্রতিবছরই এ নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা যায়। বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে প্রথম হলো, নাকি তৃতীয়, এ অবস্থান আসলে মূল বিষয় নয়। আসল বিষয় হলো, চাহিদার তুলনায় জোগান কতটা নিশ্চিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যা বেশি, তাই পণ্যের চাহিদাও স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকবে। শাক-সবজির উৎপাদন যে বেড়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উৎপাদন জনগণের প্রয়োজন মেটাচ্ছে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।