এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সোর্সিং গন্তব্য হিসেবে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করেছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মার্কিন ক্রেতাদের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত অনুসন্ধান আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ। বাণিজ্য উত্তেজনা ও শুল্কের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো ক্রমেই চীন থেকে সরে আসছে, যা এই প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিউআইএমএ ব্যারোমিটারের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বিদেশি ক্রয় প্রক্রিয়া কিছুটা ধীর হলেও বাংলাদেশসহ আশপাশের কয়েকটি দেশ পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে কোয়ালিটি ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট সাপ্লাই চেইন কমপ্লায়েন্স সেবা প্রদানকারী একটি শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সোর্সিং পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
চীনের পতন, দক্ষিণ এশিয়ার উত্থান : ২০২৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে চীনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষার পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ কমেছে। শুল্ক আরোপ ও সাপ্লাই চেইন ঝুঁকি কমানোর কৌশলের ফলেই এমনটি ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে, চীনের ঘাটতি পূরণে অন্যান্য এশীয় দেশগুলো এগিয়ে এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিদর্শন কার্যক্রম বেড়েছে ৩৯ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় দ্বিগুণ অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কা সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, মূলত নতুন অর্ডার বৃদ্ধির কারণে। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৩৬, ২১ ও ১৪ শতাংশ।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত : যদিও এই প্রবণতা ইতিবাচক, কিউআইএমএ সতর্ক করেছে যে মার্কিন সোর্সিংয়ের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। নতুন ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ’ নীতির কারণে চীনের পরোক্ষ রপ্তানি কমানোর প্রচেষ্টা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হাব যেমন ভিয়েতনামের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া, আগস্টের শেষ দিকে ভারতের সঙ্গে বাড়তে থাকা বাণিজ্যিক উত্তেজনাও সোর্সিং ডেটায় প্রতিফলিত হয়েছে, যা বৈচিত্র্য আনার বর্তমান গতিধারায় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। নিজস্ব উৎপাদনে অগ্রগতি নেই যুক্তরাষ্ট্রে : ‘নিয়ারশোরিং’ ও ‘রিশোরিং’ উদ্যোগেও যুক্তরাষ্ট্র এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ২০২৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ক্রয়ের মাত্র ৮ শতাংশ এসেছে তাদের নিজস্ব অঞ্চল থেকে। ফলে মার্কিন খুচরা বিক্রেতা ও নির্মাতারা এখনো এশিয়ার ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।
চীনের নজর লাতিন আমেরিকায় : যখন মার্কিন চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তখন চীন লাতিন ও দক্ষিণ আমেরিকার উদীয়মান বাজারগুলোতে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করেছে। চীনা টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক্স ও হোমওয়্যার খাতে পরিদর্শন কার্যক্রম ব্রাজিলে ৫৪ শতাংশ, উরুগুয়েতে ৬৯ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনায় ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইউরোপীয় বাজারেও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি : ইউরোপীয় ক্রেতারা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল সোর্সিং কৌশল বজায় রেখেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিদর্শন চাহিদা বেড়েছে ৮ শতাংশ, যেখানে নেতৃত্ব দিয়েছে ভিয়েতনাম (২১ শতাংশ), থাইল্যান্ড (১৮ শতাংশ), এবং কম্বোডিয়া (১০ শতাংশ)। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেও ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে মরক্কোতে ১৫ শতাংশ, তিউনিসিয়ায় ১৯ শতাংশ এবং মিসরে ২৪ শতাংশ পরিদর্শন কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। মিসরের এই সাফল্যকে তুরস্কের বিকল্প হিসেবে তার ক্রমবর্ধমান ভূমিকার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের আশাবাদী পোশাক খাত : বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া, যারা উচ্চমানের পোশাক বাজারে কাজ করে, তারা বর্তমানে বিশেষভাবে ভালো করছে।
তিনি আরও জানান, মার্কিন ভোক্তারা কেনাকাটা কমিয়ে দেওয়ায় জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কাজের অর্ডার কিছুটা কমেছিল। তবে আমরা আশা করছি, ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তিকে অর্ডারের প্রবাহ আবারও বাড়বে। তার মতে, ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা এখন ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্ক আরোপের পর ভারত ও চীন উভয় দেশই সেখানে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহীভাবে কাজ করছে।