প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং বিভিন্ন খাতের বাজেট বাস্তবায়নে চাপ বাড়ছে। ই প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আয় বাড়াতে এবার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। রাজস্ব আহরণে কাঠামোগত সংস্কার, কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি রোধে মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সরকার গঠন করেছে ৯ সদস্যের একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি।
প্রতিটি কর অঞ্চলে গোয়েন্দা সেল : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনায় দেশের প্রতিটি কর অঞ্চলকে নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেল গঠন ও তা কার্যকরভাবে পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সেলগুলোর মূল কাজ হবে কর ফাঁকির সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা, তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনে তদন্ত পরিচালনা করা। কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট টিম তা এনবিআরের ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন কমিটির কাছে উপস্থাপন করবে। এরপর নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আইনানুগভাবে কর পুনরুদ্ধারের অনুমোদন দেওয়া হবে। এনবিআরের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, আগে কর ফাঁকি শনাক্তের কাজ মূলত কাগজনির্ভর ছিল, এখন তা ডিজিটাল পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে ফাঁকিদাতারা সহজে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কড়া নজরদারি : এনবিআর জানিয়েছে, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর অংশ হিসেবে কর ফাঁকির অভিযোগ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য, আয়কর রেজিস্টারে অসংগতি (যেমন ঘষামাজা, কাটাছেঁড়া), অস্বাভাবিক করমুক্ত আয়, অথবা করযোগ্য আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট টিম তদন্ত শুরু করবে। প্রতিটি কর কমিশনারেটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, গোয়েন্দা কার্যক্রম থেকে সৃষ্ট অতিরিক্ত কর দাবি ও আদায়ের তথ্য প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠাতে হবে।
কাঠামোগত সংস্কারের দিকে সরকারের দৃষ্টি : এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, কর ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার জাতীয় পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি দেশের কর কাঠামো, আইন ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করবে এবং কর-জিডিপি অনুপাতকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় উন্নীত করতে সুপারিশ করবে। আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে কমিটিকে অর্থ উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তলানিতে অন্যতম। এটি যদি ১২-১৫ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তাহলে সরকার স্বনির্ভর উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ নিতে পারবে।’
ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে কর শনাক্তকরণ : রাজস্ব আহরণে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার ওপরও জোর দিয়েছে এনবিআর। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যভান্ডারের সঙ্গে এনবিআরের ডেটা সিস্টেমকে ডিজিটালি সংযুক্ত করা হচ্ছে। এতে করদাতার প্রকৃত আয়, সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য সহজেই যাচাই করা সম্ভব হবে। এনবিআরের চেয়ারম্যানের এক বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা আসবে এবং স্বতঃপ্রণোদিত কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।’
রাজস্ব ঘাটতির চিত্র : অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছর ধরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই আয়কর ও মূসক খাতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি কর প্রশাসনে মানবসম্পদ উন্নয়ন, করদাতার আস্থা পুনর্গঠন এবং প্রণোদনাভিত্তিক সংস্কৃতি তৈরি জরুরি।
বিশেষজ্ঞ মত : করনীতি বিশ্লেষক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘রাজস্ব আহরণে প্রযুক্তির ব্যবহার, করদাতা সেবা উন্নয়ন এবং নীতি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি অনেকটাই কমানো সম্ভব।’