দেশের ব্যাংক খাতের অনিয়ম, খেলাপি ঋণ নিয়ে নানা জটিলতার মধ্যে এবি ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা ধরে রেখেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর একাধিক বেসরকারি ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে পড়েছে। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এমনকি ১ লাখ টাকার চেক দিয়েও টাকা পাননি। তবে এখন পর্যন্ত এবি ব্যাংক থেকে কোনো গ্রাহককে ফেরত যেতে হয়নি। দেশের তালিকাভুক্ত প্রথম বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক পিএলসি। চার দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুবার শীর্ষস্থানে ছিল। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সাম্প্রতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, খেলাপি ঋণ, আর্থিক কাঠামো নিয়ে কথা বলেন।
মিজানুর রহমান বলেন, জনগণের প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করেই ব্যাংকিং হবে। এবি ব্যাংক জনগণের ব্যাংকিং করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য এখন আর্থিক স্থিতিশীলতা ও গ্রাহক আস্থা পুনর্গঠন। এর অংশ হিসেবে ব্যাংক : নতুন আমানত পণ্য চালু করেছে। সাব-ব্র্যাঞ্চ ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি ও এসএমই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছি। করপোরেট ঋণ বিতরণ আপাতত সীমিত রাখা হয়েছে। অতীতে করপোরেট ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা ছিল। যা ব্যাংকিং খাতে কিছুটা চাপ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর এবি ব্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধার। গ্রাহকরা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। তার প্রমাণ এখন পর্যন্ত অর্জিত সাফল্যগুলো হলো- নতুন আমানত সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ৮,৯৪০ কোটি টাকা। নতুন হিসাব (চলতি ও সেভিংস) খোলা হয়েছে ৩১ হাজার ২০০। গত ৮ মাসে ২৮.২৫ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে এবি ব্যাংকের মাধ্যমে। এলসির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। বর্তমান সংকটের মধ্যে এই অর্জনগুলো প্রমাণ করে এবি ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা কতখানি অটুট রয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাতের ওপর অনাস্থার কারণে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
এবি ব্যাংক একসময় ব্র্যান্ড ব্যাংক ছিল, সেটা এবি ব্যাংক ধরে রেখেছে। সারা দেশে ব্যাংকের উপস্থিতি আছে। এর মাধ্যমে সারা দেশে নতুন সেবা ছড়িয়ে দিতে চাই। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন, যা ঋণ উদ্ধারকে কঠিন করে তুলেছে। তবে আশার কথা, সামনে জাতীয় নির্বাচন। মনোনয়নপ্রার্থীরা সাধারণত নিজেদের সিআইবি রিপোর্ট পরিষ্কার রাখতে চান। ফলে এ সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের আশা করছি। ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে এবি ব্যাংকের ১,২০০ মামলা চলছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। মামলা নিষ্পত্তির ধীরগতি খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে বড় বাধা। মিজানুর রহমান বলেন, যদি বিচার ব্যবস্থার গতি না বাড়ানো যায়, খেলাপি ঋণ আদায় কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কমপক্ষে ১০টি বিশেষ অর্থঋণ আদালত গঠন করা উচিত। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে অর্থ ঋণ আদালত নেই। এ দুই জায়গায় যে পরিমাণ মামলা পেন্ডিং আছে সেগুলো সেটেল হতে কয়েক বছর লেগে যাবে।
এভাবে কখনো খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত উচিত অর্থ ঋণ আদালতের সংখ্যা বাড়ানো। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে সামগ্রিক ব্যাংকিং পদ্ধতিটা অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে আসছে। নতুন প্রজন্ম ব্যাংকে এসে ব্যাংকিং করতে আগ্রহী নন। পশ্চিমা দেশগুলো এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, আমরাও চেষ্টা করছি তাদের মতো করে। এ জন্য আমাদের মধ্যে বড় ধরনের সচেতনতা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের একটি বার্তা দেওয়া দরকার, সেই সঙ্গে সব ব্যাংকের পক্ষ থেকেও আলাদা ক্যাম্পেইন জরুরি। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জন্য আমাদের একটি অ্যাপ রয়েছে। আমরা আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি, গ্রাহক যাতে ঘরে বসে হিসাব খোলা ও লেনদেন করতে পারেন। পাশাপাশি আমাদের কার্ড সিস্টেম আরও ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেয়ার হোল্ডারদের সাপোর্ট প্রয়োজন। এ মুহূর্তে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য হয়তো কোনো সুখবর দিতে পারব না। তাই তাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। শেয়ারহোল্ডারদের যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি। এই সাপোর্ট ভবিষ্যতে থাকবে। এভাবে চললে আশা করি, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য অবশ্যই ভালো কিছু আসবে। আমি সব গ্রাহকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি মনে করি, এই খারাপ সময়ে তারা যদি আমাদের পাশে থাকে তাহলে খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াব। দেশের শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হবে এবি ব্যাংক।