অর্থনৈতিক সংহতি জোরদার ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সদস্য বঙ্গোপসাগরের অববাহিকতায় অবস্থিত দেশগুলো ক্রসবর্ডার ডিজিটাল পেমেন্টব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার পটভূমিতে উদ্যোগ : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতি যে অস্থিরতায় পড়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। মার্কিন ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, ক্রমবর্ধমান লেনদেন ব্যয় এবং বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে অনেক আঞ্চলিক অর্থনীতি বিকল্প আর্থিক কাঠামোর দিকে ঝুঁকছে। এই প্রেক্ষাপটে সদস্য দেশগুলো (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড) নিজস্ব ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো তৈরির সম্ভাবনা যাচাই করছে।
এডিবির সহায়তায় প্রাথমিক কাজ শুরু : বিমসটেকের মহাসচিব ইন্দ্র মণি পাণ্ডে জানিয়েছেন, সংস্থাটি সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় একটি পরামর্শক কর্মশালা আয়োজন করেছে, যেখানে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন লেনদেনের জন্য একটি আঞ্চলিক পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করা হয়। এ ধারণাটি প্রথম উত্থাপিত হয় গত নভেম্বরের ব্যাংকক সম্মেলনে। বর্তমানে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ডিজিটাল পেমেন্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে, বলেন তিনি।
ব্যয় হ্রাস, স্বচ্ছতা ও আস্থা বৃদ্ধি : পাণ্ডের মতে, একটি অভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা তৈরি হলে নগদের ওপর নির্ভরতা কমবে, লেনদেন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়বে। এর ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আস্থা জোরদার হবে এবং অর্থনৈতিক সংহতি আরও গভীর হবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল পেমেন্ট কেবল একটি সুবিধা নয়, এটি উদ্ভাবন ও অন্তর্ভুক্তির চালিকাশক্তি। বে অব বেঙ্গল অঞ্চলের অর্থনীতিকে এটি আরও সংযুক্ত ও স্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ : প্রস্তাবিত এই পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রেমিট্যান্স লেনদেন দ্রুততর হবে, ই-কমার্স সম্প্রসারণ হবে এবং ব্যবসা পেমেন্ট আরও সহজ হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা আঞ্চলিক বাজারে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন যা অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রসবর্ডার বাণিজ্য এখনো প্রধানত নগদ নির্ভর ও ব্যাংকভিত্তিক, যেখানে লেনদেন প্রক্রিয়া ধীর এবং ব্যয়বহুল। ডিজিটাল পেমেন্ট কাঠামো চালু হলে তা বাণিজ্য প্রবাহে গতি আনবে এবং অবৈধ অর্থপ্রবাহ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখবে।
আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও নীতি সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ : তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বিমসটেকের এ উদ্যোগ সফল করতে হলে সাইবার নিরাপত্তা, তথ্য সুরক্ষা, মুদ্রা রূপান্তর নীতি এবং বিধিবদ্ধ কাঠামোগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, যদি বিমসটেক দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ‘ক্রসবর্ডার পেমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করতে পারে, তবে এটি এশিয়ার আঞ্চলিক সংহতির নতুন অধ্যায় হয়ে উঠবে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো দুটিই এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়াতে নতুন চেম্বার : বিমসটেক একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা জোরদারে ‘বিমসটেক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিমসটেক সিসিআই)’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই চেম্বার আঞ্চলিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি, বিনিয়োগ সহজীকরণ ও প্রযুক্তি বিনিময়ে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিমসটেকের ক্রস বর্ডার ডিজিটাল পেমেন্ট উদ্যোগ কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি একটি আর্থিক কূটনীতির পদক্ষেপ, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশসহ পুরো বে অব বেঙ্গল অঞ্চল বিশ্ববাণিজ্যে একটি নতুন ডিজিটাল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। ১৯৯৭ সালে বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড এই সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিমসটেক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতু।