জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ব্যাপক মাত্রার (ওয়াইড স্প্রেড) বা পদ্ধতিগত (সিস্টেমেটিক) নিপীড়নের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয় বলে যুক্তি তুলে ধরেছেন আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন থেকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে হত্যার অভিযোগ এনেছে, এটাও সঠিক নয়। লক্ষ্যভিত্তিক কোনো হত্যাকান্ড এখানে হয়নি। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের যুক্তি খন্ডন করে এসব কথা বলেন তিনি। পরে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে এ মামলার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৬ অক্টোবর টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে প্রসিকিউশন। ওই দিন হাসিনা-কামালের মৃত্যুদন্ড চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও এই মামলার আসামি। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এদিন প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, বিএম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
অন্যদিকে ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আরও দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের ১৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন ওই ঘটনায় নিহত বায়েজিদ বোস্তামীর ভাই কারীমুল ও প্রসিকিউশনের ১৮ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপার এনায়েত। পরে তাদের জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার মামলায় গতকাল যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতেই আমির হোসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, এটা এমন একটি আইন যে যেখানে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে সাঁতার কাটতে বলার মতো। যেমন সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি এখানে প্রযোজ্য নয়। এখানে সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল। একই সঙ্গে যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই এই আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। তাই আইনটি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
এ মামলার আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের দেওয়া যুক্তিতর্ক খন্ডন করে আমির হোসেন বলেন, আন্দোলন দমন সরকারের ‘ওয়াইড স্প্রেড’ কিংবা ‘সিস্টেমেটিক’ বলা হয়েছে সেটা সঠিক নয়। এখানে সরকারের টার্গেট ছিল না। থাকলে শুধু রংপুরে আবু সাঈদ নয়, আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় থাকা হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, নাহিদ ইসলামসহ অন্যদেরও টার্গেট করে হত্যা করা হতো। ১ হাজার ৫০০ আন্দোলনকারী মারা গেলেও তারা মারা যাননি। ফলে এটা টার্গেটভিত্তিক ব্যাপক মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ ছিল না। প্রসিকিউশনের বক্তব্য সঠিক নয়। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, টার্গেটেড মানে সবাইকে মেরে ফেলতে হবে, এটা বোঝায় না। স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো নেতা মারা যায়নি। একাত্তরে কোন নেতা মারা গেছে? জবাবে আমির হোসেন বলেন, একাত্তরে তারা মারা যাবে কেন, তারা তো সবাই ভারতে ছিল। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন এক নম্বর নেতা তো (শেখ মুজিবুর রহমান) পাকিস্তানে ছিলেন, তিনি মারা গেছেন?
যুক্তিতর্কে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, কোনো আন্দোলন যদি বৈধও হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। সেটাই তারা করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ভুল ছিল। কোটা পদ্ধতিকে প্রধানমন্ত্রী বিলোপ করেছেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হাই কোর্টে রিট করলেন। সেই রিটের রায়ে আবার কোটা পুনর্বহাল হলো। সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি দেশে বিচারকের ওপর নির্বাহী বিভাগ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, এক দিনের মধ্যে শুনানি করলেন কীভাবে? অ্যাটর্নি জেনারেল যদি না থাকে, তিনি যদি দুই মাস ছুটি নিয়ে বসে না থাকে, এটা প্রভাব নয় কি? আপনি যদি অ্যাক্টিভলি পার্টিসিপেন্ট না করেন, ডিস্পোজালের যদি ব্যবস্থা না করেন, কোর্টকে যদি সহযোগিতা না করেন, সেটাই তো ইনফ্লুয়েন্ট করা। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সব ম্যাটারিয়ালস সরকারের হাতে। আমরা এখানে মামলা করছি, প্রসিকিউশন সাইট যদি অফ থাকে, আমরা মামলা চালাতে পারব না।
এ পর্যায়ে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একমত হয়ে তাহলে কি ধরে নেব এই বিচার রাষ্ট্র যা চাইবে তা হবে? জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, না তা হবে না, তবে সুইচগুলো সরকারের হাতে, চাইলেই টিপ দিয়ে বন্ধ করে ফেলা যায়। এ পর্যায়ে আমির হোসেন বলেন, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, বর্তমান সরকার বা রাষ্ট্র সেই সুইচগুলোর কোনটা ব্যবহার করতেও পারে। জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, পারে তবে যখন রায়ের প্রশ্ন আসবে, তখন আমরা সরকারকে কেয়ার করি না। জবাবে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ঠিক একইভাবে কোটার মামলায়ও সবকিছু বিচার বিভাগের ওপরেই ছিল, এখানে তৎকালীন সরকারের কিছুই করার ছিল না। এর পরও প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের সঙ্গে বসতে চেয়েছিলেন। যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি। যারাই মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছেন শুধু তাদেরকেই তিনি রাজাকার বলেছেন। আর এখন রাজাকার কজন আছে, সবাই তো মারা গেছে। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাজাকার হচ্ছে একটা গালি। এখন কারা রাজাকার ছিল, কারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল সেটা বিচারের বিষয় নয়।
প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপনের বিরোধিতা করে আমির হোসেন বলেন, এই মামলার পটভূমিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ছিল। প্রসিকিউশনের এ ধরনের বক্তব্য আমি মেনে নিতে পারছি না। এগুলো প্রসিকিউশনের ব্যক্তিগত বয়ান। কারণ এই সময়ে দেশে অনেক উন্নয়ন ও সুশাসন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাস্তাঘাট, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্র ও পরিবারের মধ্যে অনেক মিল আছে। পরিবারের প্রধান চান সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দুই-একটা খারাপ কাজ হতেই পারে। সেটাকে বড় করে দেখা যাবে না। তা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সময় অনেক কাজ পক্ষে যায় আবার অনেক বিপক্ষে যায়। পৃথিবীর শুরু থেকেই এসব হয়ে আসছে। এ সময় মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের আমলের অনেক হত্যাকান্ডের উদাহরণ টেনে আনেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্কে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনী পছন্দ করে না। এটা সঠিক নয়। পছন্দ না হলে তাদের এত সুযোগসুবিধা দেওয়া হতো না। তা ছাড়া পিলখানা হত্যাকান্ড ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগের বিষয়ে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবসহ অন্যরা জড়িত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তো আসামিদের ছেড়ে দেননি। কঠিন বিচার হয়েছে। একই সঙ্গে আবরার হত্যা ও বিশ^জিৎ হত্যার ঘটনায় নিজের দলের লোকদেরও বিচারের মুখোমুখি করেছেন তিনি। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সময়ে বিচারবিহীন ব্যবস্থা ছিল, তার দলীয় লোকদের বিচার করত না, প্রসিকিউশনের এসব যুক্তি সঠিক নয়।