ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ খাতে এখন ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর দুই বছরেও পাওনা এবং কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ দূর হয়নি। এ বিরোধ মেটাতে আদানি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যেতে পারে। বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) আদানির কাছে এক মাস সময় চেয়েছে। এরই মধ্যে আইনি পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে আদানি। নতুন করে এবার আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ভারত সরকার দেশটির জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছে। অথচ এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য ২৫ বছরের চুক্তি রয়েছে। এরই মধ্যে ২৭ সেপ্টেম্বর তারা পাওনা মেটাতে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে। সব মিলে ভারতের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পিডিবির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, বাংলাদেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার করা হয়, তার দাম প্রতি টনে ১৫ থেকে ২০ ডলার বেশি। ভারতের অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের চেয়ে আদানির বিদ্যুতের দামও বেশি। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত চীন ও এস আলম গ্রুপের যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম পড়ছে ৬৫ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে। পিডিবির সাম্প্রতিক হিসাবে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৬৫ ডলারের আশপাশে। আদানি ৮০ ডলার চাইছে। পিডিবি সূত্র জানিয়েছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা ৮৭ পয়সা। একই সময়ে ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমদানির ক্ষেত্রে গড়ে ইউনিটপ্রতি খরচ ৮ টাকা ৪০ পয়সার মতো। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই আদানির বিল বকেয়া পড়ে। তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ডলার বা প্রায় ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়। পিডিবি বলছে, গত জুন পর্যন্ত আদানির বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কয়লার বাড়তি দাম ধরে আদানির করা বিল অনুযায়ী বকেয়া জমা পড়েছে প্রায় ২০ কোটি ডলার (প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা)। ২৩ জুন আদানি ও পিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করেন; কিন্তু বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি বাংলাদেশকে ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া পরিশোধের আহ্বান জানিয়েছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ২৩ জুন বৈঠকে পিডিবির কর্মকর্তারা তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন সব বকেয়া ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে। এমনটি না হওয়ায় তাঁরা আবারও চিঠি পাঠান। পিডিবি গত জুনে আদানি পাওয়ারকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য ৩৩৬ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করেছে।
নতুন করে ভারতের গড্ডায় নির্মিত আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ভারত সরকার দেশটির জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছে। ভারতের কাহালগাঁও এ-মেইথন বি ৪০০ কেভি লাইনের লাইন ইন লাইন আউট (এলআইএলও) ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সংযোগ হবে। এর আগে গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ২৯ সেপ্টেম্বর এ আদেশ জারি করেছে বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩-এর ধারা ১৬৪-এর অধীনে। এর আগে গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরদিন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য চিঠি দেয় আদানি কর্তৃপক্ষ।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, আদানি চুক্তির বাইরে ছাড় দিতে রাজি নয়। বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় সিঙ্গাপুরের আইনি পরামর্শক ডাক্সটন হিল চেম্বারসকে নিয়োগ দিয়েছে তারা। এর সঙ্গে থাকছে সিঙ্গাপুরের আরেক আইনি প্রতিষ্ঠান দি আরবিট্রেশন চেম্বারস।
পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আইনি পরামর্শক নিয়োগে আমরা এক মাস সময় চেয়েছি। আদানি কয়লার যে দাম চাইছে, তা সত্য হলে দিতে সমস্যা নেই। কিন্তু একই সূচক অনুসরণ করে অন্য জায়গা থেকেও আমরা কয়লা কিনছি। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যায়।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘এ ইস্যুটি আন্তর্জাতিক দক্ষ আইনজীবীর কাছে নিয়ে যেতে হবে। চুক্তির অসমতা এবং কয়লার মূল্য নির্ধারণের যে প্র্যাকটিস আছে তা আইনি মাধ্যমেই ঠিক করতে হবে। বিশ্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে চুক্তি হয়, তার সঙ্গে আদানির চুক্তি কতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তা দেখতে হবে। এজন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ এটি দীর্ঘ ২৫ বছরের চুক্তি।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তি পর্যালোচনার জন্য সরকারের গঠিত একটি কমিটি কাজ শুরু করে। সেই কমিটি সূত্রে জানা যায় চুক্তিটি ‘অসম’। আদানিকে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। চুক্তিতে উল্লিখিত কয়লার দাম দেখে মনে হয়েছে বিদ্যুৎ নয়, কয়লা বিক্রি করেই ব্যবসা করতে চেয়েছে আদানি।