হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস কী?
হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়াকে হাড়ক্ষয় বলে। এতে হাড় ফাঁপা এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলে সামান্য আঘাতে বা বিনা আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। হাড়ক্ষয় রোগকে কাঠে ঘুণে ধরার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজন হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছেন এবং তাদের সবারই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। অথচ তারা জানেই না যে তাদের হাড়ক্ষয় রোগ আছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে ৫০০ মিলিয়ন পুরুষ ও মহিলা হাড়ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। কিছু পরিসংখ্যান দিলে হাড়ক্ষয় রোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। বিশ্বে হাড়ক্ষয়ের কারণে প্রতি বছর ৫৫ বছরোর্ধ্ব ৩৭ মিলিয়ন মানুষের হাড় ভেঙে যায়, অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ৭০ জন মানুষের হাড় ভেঙে যাচ্ছে-পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষের হাড় ভাঙার ঝুঁকি ৪০% এবং এটা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সমান। নারীদের হাড়ক্ষয়জনিত কারণে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা সম্মিলিতভাবে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও স্তন ক্যান্সারের (যোগফলের) চেয়েও বেশি। আশ্চর্যের বিষয় যে শতকরা ৮০ জন মানুষই জানে না যে তার হাড়ক্ষয় আছে এবং হাড় ভেঙে গেছে, (বিশেষ করে মেরুদন্ডের হাড়) এবং তারা কেউই হাড়ক্ষয়ের চিকিৎসা গ্রহণ করেনি।
নীরব ঘাতক : হাড়ক্ষয় রোগের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। হাড় ক্ষয়ের কারণে হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে ভেঙে গেলে মানুষ সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যায়। একজন হাড়ক্ষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গেলে তার মৃত্যুঝুঁকি ৮ গুণ বেড়ে যায়। আর উরুসন্ধির হাড় ভেঙে গেলে তাকে সাধারণত অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
বিশ্ব হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস দিবস ২০২৫ : প্রতিবছর ২০ অক্টোবর বিশ্বে হাড়ক্ষয় রোগ ও তার কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ জটিলতা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা তৈরি করার জন্য ‘বিশ্ব হাড়ক্ষয় দিবস’ পালন করা হয়। গতকাল পালিত হয়েছে এ দিনটি। এবারের বিশ্ব হাড়ক্ষয় দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘এটা অগ্রহণযোগ্য!’ (It's Unacceptable). সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস যতেœ বিশ্বব্যাপী অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরে, ফ্র্যাকচারে আক্রান্ত এত লোকের রোগ নির্ণয় না করা এবং চিকিৎসা না করা, অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। প্রয়োজনীয় রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা সহ ফলোআপ যতেœর অভাবে লাখ লাখ লোক আরও ফ্র্যাকচার এবং অক্ষমতার ঝুঁকিতে পড়ে।
উপসর্গ কী : হাড়ক্ষয় রোগের সাধারণত তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। কিছু কিছু কারণে আমরা অনুমান করতে পারি যে, হাড়ক্ষয় হতে পারে। যেমন- যাদের ক্ষেত্রে উল্লিখিত ঝুঁকিগুলো আছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী কোমর ব্যথা, মেরুদন্ড বাঁকা বা কুঁজো হয়ে যায়, উচ্চতা কমে যাওয়া এসব উপসর্গ থাকে। তবে বেশির ভাগ মানুষই হাড় ভেঙে যাওয়ার উপসর্গ নিয়ে আসে।
করণীয়গুলো : চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’। প্রতিরোধ শুরু করতে হবে শিশুকাল থেকেই। শিশুকাল থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের হাড়ের ঘনত্ব অনেক বেশি করে সঞ্চয় করে রাখতে হবে যাতে পরবর্তীতে হাড় মজবুত থাকে।
১) খাবার : নিয়মিত সুষম খাবার খেতে হবে যাতে প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১.২ গ্রাম প্রোটিন থাকে। পরিমিত ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি খেতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় নিম্নোক্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে যাতে প্রচুর ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যেমন- দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার, টকদই, পনির, কমলা, ডিম, কাঠবাদাম, তিল, খেজুর, সয়াবিন, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি মাছ। সবুজ শাকসবজিও ক্যালসিয়ামের খুব ভালো উৎস। কয়েকটি খাবার বা খাদ্য উপাদান আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রয়েছে যেগুলো আমাদের হাড়ের জন্য ক্ষতিকর। যেমন- লবণ অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড, সফট ড্রিংকস, চা ও কফির মধ্যে থাকা ক্যাফেইন, অতিরিক্ত প্রোটিন বা প্রাণিজ প্রোটিন ইত্যাদি। এগুলো পরিহার করতে হবে।
২) ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার : ভিটামিন-ডি শুধু হাড়ের জন্য নয় দেহের সুস্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি পাওয়া যায় এমন সব খাবারের সংখ্যা খুবই কম। আর যেসব খাবারে ভিটামিন-ডি থাকে সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় খুবই অল্প থাকে। তৈলাক্ত মাছ, কলিজা, ডিমের কুসুম, মাখন, উন্নত প্রজাতির মাশরুম প্রভৃতি ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার।
৩. ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। কোমলপানীয় এড়িয়ে চলা। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সম্ভব হলে খালি গায়ে সূর্যালোকে থাকার চেষ্টা করা।
৫. প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বা দৌড়ানোর ব্যায়াম করা। মাংসপেশির ব্যায়াম করলে যেমন হাড়ক্ষয় রোধ করে তেমনি মাংসপেশি সবল ও মজবুত করে, ফলে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
৫. বয়স্ক রোগীরা যাতে ঘরের মেঝেতে, সিঁড়িতে বা বাথরুমে পড়ে না যার তার ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য করণীয় : হাড়ক্ষয় নির্ণয়ের জন্য সব সবচেয়ে সহজ ও নির্ভরযোগ্য নিরাপদ পরীক্ষা DXA.-এর মাধ্যমে আমরা হাড়ের ঘনত্ব (BMD) পরিমাপ করতে পারি।
লেখক : অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম
অর্থোপেডিক্স, ট্রমা ও স্পাইন সার্জন,
ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল ও সুপার
স্পেশালিটি সেন্টার, ঢাকা।