ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন মন্ত্রণালয়ের কী কাজ তা বুঝিয়ে দিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। নির্বাচন-সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়ন, ভোট কেন্দ্রের লজিস্টিকস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্যসহায়তা এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছেন, বৈঠকে গণভোট নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর মাঠ প্রশাসনে ‘বড়’ রদবদলের উদ্যোগ নেবে ইসি।
এদিকে দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং সুবিধা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। উপজেলায় উপজেলায় প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে হেলিপ্যাড। কোনো অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন, সরঞ্জাম ও ফায়ার সার্ভিস কর্মী প্রস্তুত রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি যেন নির্বাচনের সঙ্গে না মিলে যায় সেদিকে সতর্ক থাকতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে করার জন্য আমরা সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
গতকাল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইসি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়সভা করে। সভা শেষে আখতার আহমেদ এসব বিষয় জানান। সভায় নির্বাচন-সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়ন, ভোট কেন্দ্রের লজিস্টিকস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্যসহায়তা এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আখতার আহমেদ। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। সভায় চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। সভায় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে বদলি নিয়ে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তফসিল ঘোষণার পর আমরাও সেভাবে জানাব।’ ইসি সচিব বলেন, ‘কমিশন ভোট কেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণসংক্রান্ত বিভিন্ন বাস্তব সমস্যা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরে এনেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ভোট কেন্দ্র এবং সেখানে যাওয়ার রাস্তা মেরামত ও সংস্কারের অনুরোধ জানিয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে আবহাওয়া অনুকূল থাকলেও আগে থেকেই এসব কেন্দ্রের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা নির্বাচনি কাজে ব্যবহৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগেভাগে প্রস্তুত করে রাখেন।’
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রসঙ্গে আখতার আহমেদ বলেন, ‘ইসি প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছে, যেখানে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও থাকবেন। আমরা চাই নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে।’ তিনি জানান, সভায় পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা হয়, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার ল্যান্ডিংসুবিধা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরাও বিস্তারিতভাবে তাঁদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে ভোটের দিন প্রতিটি উপজেলায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়েও ক্লাস্টারভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। এসব টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। সভায় নির্বাচনি প্রচার ও জনসচেতনতা কার্যক্রম নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) নেতৃত্বে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা হয়। ইসি সংসদ টেলিভিশনের এয়ারটাইম এবং বিটিভি নিউজের ফ্ল্যাশ বার্তা ব্যবহার করে ভোটার সচেতনতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আগমনের ক্ষেত্রে ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত করার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি সভায় জানান, ঋণখেলাপসংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদ ও প্রদানের জন্য তাঁদের চার-পাঁচ দিন সময় প্রয়োজন। ইসি তাঁদের সময় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানায়।
বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গে সচিব বলেন, অর্থ বিভাগের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, তবে সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। ভোটের সময় নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের যথাযথভাবে নিয়োগ নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বিষয়ে জোর দিয়ে ইসি সচিব বলেন, ভোট গ্রহণ ও গণনার সময় যেন বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। তিনি বলেন, ‘প্রবাসী ভোটার, সরকারি চাকরিজীবী ও নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জন্য পোস্টাল ব্যালটের নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করতে ইসি কাজ করছে। আমরা পোস্টাল ভোটিংয়ের একটি ট্রায়াল অ্যাপ তৈরি করেছি, যা ১৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ভ্রান্ততথ্য ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হবে, যাতে ভুল তথ্য প্রচার বন্ধ রাখা যায়।
সচিব বলেন, নির্বাচনের সময় প্রতিটি জেলায় ফায়ার সার্ভিসের টিম প্রস্তুত থাকবে। কোনো অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন, সরঞ্জাম ও কর্মী প্রস্তুত থাকবে। জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের দাবি জানানো আটটি দলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সচিব বলেন, ইসি তাদের মতামত শুনেছে, তবে গণভোটের সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।
হ্যান্ডশেকের মতো প্রতীক নতুন করে তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে, এটা বাস্তবসম্মত কি না-জানতে চাইলে ইসি সচিব এড়িয়ে যান। প্রতিদিন ইসিতে বিভিন্ন দল আসছে দাবি নিয়ে, এটাকে ইসি চাপ মনে করছে কি না-জানতে চাইলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনের তিনটি মূলধারা। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক দল, আরেকটি ভোটার এবং নির্বাচন কমিশন নিজেই। এ তিনটি একটি আরেকটির সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করতেই আসবে এবং করতে আসার অর্থই এই নয় যে আমরা চাপের মধ্যে আছি। এটা চিন্তা করাটা অত্যন্ত অমূলক।’