‘বিষের বাঁশি’ ছবিতে শাবনাজের চরিত্রের নাম ছিল ‘ময়না’। সেই ছবি থেকেই তাঁদের প্রেমের গভীরতা বাড়ে, আর সেই থেকে নাঈম তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে আজও ‘ময়না’ নামেই ডাকেন...
নব্বই দশকের রোমান্টিক জুটি নাঈম ও শাবনাজ। তাঁদের রুপালি পর্দার প্রেম একসময় রূপ নেয় বাস্তবের ভালোবাসায়, যা আজ ৩২ বছরের সফল দাম্পত্য জীবন হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পরিচালক এহতেশামের হাত ধরে ১৯৯১ সালে ‘চাঁদনী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তাঁদের অভিষেক। প্রথম ছবিতেই অভূতপূর্ব সাড়া জাগানো এই জুটি একের পর এক সুপারহিট ছবি উপহার দেয়।
পর্দার প্রেম যখন বাস্তব
টানা অভিনয় করতে গিয়ে দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টা একসঙ্গে কাটাতে হতো নাঈম ও শাবনাজকে। এই দীর্ঘ সময় থেকেই তাঁদের মধ্যে এক ধরনের আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নাঈম বলছিলেন, ‘তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আমরা নিজেদের মধ্যে ভালোলাগা, মন্দলাগা শেয়ার করতাম। আবার ঝগড়াবিবাদও হয়েছে অনেক বিষয় নিয়ে। পরক্ষণে আবার মিটেও গেছে।’ এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া আরও গভীর হতে থাকে। নাঈমের কথায়, পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা এবং একাধিক ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দুজনের মধ্যে ভালোলাগা এবং ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ভালোবাসার শুরু
নাঈমের ভালোবাসার প্রস্তাবটি এসেছিল সিলেটের এক মনোরম পরিবেশে, যখন তাঁরা একটি ছবির শুটিংয়ে ছিলেন। শাবনাজ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘সিলেটে আমরা একটি ছবির শুটিং করছিলাম। শট দেওয়ার পর সুন্দর একটি জায়গায় বসে আছি। এমন সময় নাঈম আমাকে প্রপোজ করেন। কথা শুনে আমি অনেক লজ্জা পাই।’ চলচ্চিত্রে এমন প্রেমের সংলাপ বহুবার বললেও বাস্তবে এ অনুভূতি একেবারেই আলাদা ছিল বলে জানান শাবনাজ। তবে ততদিনে তিনিও মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন নাঈমকে। এরপর পারিবারিক সম্মতিতে অল্প সময়ের মধ্যেই ১৯৯৪ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
জুটি জীবনের সফল চলচ্চিত্র
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একটানা অভিনয় জীবনে প্রায় ২০টিরও বেশি ছবিতে জুটি বাঁধেন নাঈম-শাবনাজ। তাঁদের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চাঁদনী’, ‘জিদ’, ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘দিল’, ‘টাকার অহংকার’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, ‘সোনিয়া’, ‘অনুতপ্ত’ এবং ‘বিষের বাঁশি’। তাঁদের প্রতিটি ছবিই হয়েছিল জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সেরা রোমান্টিক জুটি হিসেবে নাঈম-শাবনাজ এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছেন।
অভিনয় ছেড়ে সংসার জীবন
বিয়ের পর এই তারকা দম্পতি অভিনয় থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। শাবনাজ জানান, ‘নাঈম কাজ কমিয়ে দেন এবং তিনিও হাতে থাকা কিছু ছবির কাজ শেষ করে নিজেকে গুটিয়ে নেন। মূলত ‘একঘেয়ে গল্প’ এবং বৈচিত্র্যময় চরিত্রের অভাবই শাবনাজের অভিনয় ছাড়ার অন্যতম কারণ। তিনি শুধু ‘নায়িকা’ হয়ে থাকতে চাননি, ‘শিল্পী’ হতে চেয়েছিলেন।
প্রিয়তমাকে ময়না নামে
নাঈম জানান, ‘বিষের বাঁশি’ ছবিতে শাবনাজের চরিত্রের নাম ছিল ‘ময়না’। সেই ছবি থেকেই তাঁদের প্রেমের গভীরতা বাড়ে, আর সেই থেকে নাঈম তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে আজও ‘ময়না’ নামেই ডাকেন।
সফল দাম্পত্যের রহস্য
ক্যারিয়ারের একেবারে স্বর্ণযুগে, যখন নায়ক-নায়িকারা নিজেদের অবস্থান গোছাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এই জুটি। তাঁদের এ অল্প বয়সে বিয়ে দেখে এফডিসির অনেকের মধ্যেই সংশয় ছিল, তাঁরা মন্তব্য করেছিলেন, এই বিয়ে বেশি দিন টিকবে না, বিচ্ছেদ হবে। নাঈম-শাবনাজের এই দীর্ঘ তিন দশকের সংসার যেন সেই সব আলোচনা-সমালোচনার এক উপযুক্ত জবাব। নাঈম বলেন, ‘দীর্ঘ এই সংসারে আমি দিন শেষে সব সময়ই খুশি। এর কারণ, শাবনাজ। প্রথমেই বলব, সংসার ধরে রাখার জন্য সব সময় শাবনাজ চেষ্টা করে গেছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি চির কৃতজ্ঞ শাবনাজের কাছে। খারাপ সময়ে সে আমাকে আগলে রেখেছে। অনেক সময় সে যা করেছে, সেটা স্ত্রীর চেয়েও বেশি কিছু করা।’ এই সফল দাম্পত্যের রহস্য হিসেবে নাঈম তাঁদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের কথা উল্লেখ করেন। পর্দায় যেমন তাঁদের ভালোবাসা সফল হয়েছিল, বাস্তব জীবনেও তা-ই করলেন। সব আলোচনা-সমালোচনাকে পেছনে ফেলে, পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভালোবাসা আর ত্যাগের মাধ্যমে নাঈম-শাবনাজ হয়ে উঠেছেন শোবিজ জগতের অন্যতম আদর্শ দম্পতি।
