প্রিন্স মাহমুদ গানটি হাসানের জন্য তৈরি করেছিলেন। এরপর বিপ্লবকে দিয়ে চেষ্টা করলেন, কিন্তু উচ্চ নোটের গানটি বিপ্লব ঠিকমতো গাইতে পারলেন না। অবশেষে তার মনে এলো শাফিন আহমেদের নাম...
বাংলাদেশের রক সংগীতের ইতিহাসে শাফিন আহমেদ এক চিরস্মরণীয় নাম। কেবল একজন গায়ক নন, বেজ গিটার হাতে মঞ্চ কাঁপানো এ শিল্পী ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরে এলে না’, ‘হ্যালো ঢাকা’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা। ‘মাইলস’-এর মতো ব্যান্ডকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ফিডব্যাকের মাকসুদুল হক যেমনটা বলেন, শাফিন আহমেদের প্রাণশক্তি ছিল সাংঘাতিক, যা মঞ্চে পরিবেশনায় ফুটে উঠত। তার আত্মবিশ্বাস আর নিয়মিত শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে কিংবদন্তির আসনে বসিয়েছে। গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদের চোখেও তিনি ছিলেন আলাদা, কারণ একই সঙ্গে বেজ বাজিয়ে সুরেলা কণ্ঠে গান করা ভীষণ কঠিন কাজ, যা শাফিন আহমেদ অবলীলায় করে গেছেন। শাফিন আহমেদের জনপ্রিয়তা শুধু মাইলসের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। চার দশকের সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি একক শিল্পী হিসেবেও দারুণ সফল ছিলেন। বিশেষ করে মিশ্র অ্যালবামে গাওয়া তার বেশ কিছু গান তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তেমনই একটি গান হলো, ‘আজ জন্মদিন তোমার’।
গাওয়ার কথা ছিল হাসানের
প্রিন্স মাহমুদের ‘দাগ থেকে যায়’ অ্যালবামের এ গানটি আজ বাংলাভাষী মানুষের জন্মদিনের উদ্যাপনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়, তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছ্বল দিন কামনায়, ‘আজ জন্মদিন তোমার’-এ কথাগুলো যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের জন্মদিনের আবেগ আর ভালোবাসাকে ধারণ করে আছে। কিন্তু এই কালজয়ী গানটির জন্মকথাটি কিন্তু সরল পথে এগোয়নি। গানের স্রষ্টা, প্রিন্স মাহমুদ জানান, মূলত থিমভিত্তিক গান করার পরিকল্পনা থেকেই এ গানটির সৃষ্টি। তিনি মনে করলেন, একটি জন্মদিনের গান করা উচিত। গানটি লেখার পর তিনি সুর করলেন, কিন্তু সুরটি ছিল অত্যন্ত হাই-নোটের। প্রাথমিকভাবে তিনি এ গানটি ব্যান্ড তারকা হাসানের জন্য তৈরি করেছিলেন।
অবশেষে শাফিনের হাতেই আস্থা প্রিন্স মাহমুদের
রেকর্ডিংয়ের সময়ে তৈরি হলো জটিলতা। প্রিন্স মাহমুদ দেখলেন, অ্যালবামে হাসানের গানের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তখন কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়, এ নিয়ে শুরু হলো চিন্তা। তিনি এরপর বিপ্লবকে দিয়ে চেষ্টা করলেন, কিন্তু উচ্চ নোটের গানটি বিপ্লব ঠিকমতো গাইতে পারলেন না। অবশেষে প্রিন্স মাহমুদের মনে এলো শাফিন আহমেদের নাম। বেজ গিটার বাজিয়ে উচ্চ স্কেলে গান করার যে বিরল দক্ষতা শাফিনের ছিল, তাতেই প্রিন্স মাহমুদ আস্থা রাখলেন। তিনি শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করলেন। শাফিন আহমেদও রাজি হয়ে গেলেন। চ্যালেঞ্জিং এ গানটির জন্য তিনি বাসায় টানা দুই দিন অনুশীলন করলেন। এরপর সিদ্ধেশ্বরীর চারু স্টুডিওতে শুরু হলো রেকর্ডিং। প্রিন্স মাহমুদের ভাষ্যমতে, ‘একটু কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা পর রেকর্ডিং করলাম আমরা।’ কঠোর পরিশ্রমের পর গানটি যখন চূড়ান্ত রূপ পেল, তখন প্রিন্স মাহমুদ নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। তিনি স্বীকার করেন, ‘শাফিন ভাই দুর্দান্ত করলেন। আমি নিজেই অবাক। এরপর তো সবারই জানা। এ গান সবার গান হয়ে গেল।’ সাউন্ড গার্ডেনে গানটির মিউজিক হয়েছিল এবং এর সুরের জাদুতে শাফিন পৌঁছে গেলেন বাংলা গানের চিরন্তন জগতে।
শাফিন-প্রিন্সের সৃষ্টিশীল বন্ধুত্ব : মাইলস পেরিয়ে
প্রিন্স মাহমুদ ও শাফিন আহমেদের শিল্পী সম্পর্ক ছিল বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো গভীর ও আন্তরিক। প্রিন্স মাহমুদের লেখা প্রায় ১০টির মতো গান গেয়েছেন শাফিন, যার বেশির ভাগই ছিল একক বা মিশ্র অ্যালবামের জন্য। ‘আজ জন্মদিন তোমার’ ছাড়াও প্রিন্স মাহমুদের অত্যন্ত প্রিয় একটি গান ছিল ‘প্রতি রাত নির্ঘুম রাত, আসে না কিছুতেই প্রভাত’।
‘শেষ দেখা’ অ্যালবামের এ গানটির বিষয়ে প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘শাফিন ভাই এটি অত্যন্ত সুন্দর গেয়েছিলেন। বিশেষ করে, ‘উৎসাহ নেই কাজে, পথ চলা নিয়ে সংশয়, ঘুমের ওষুধ বন্ধু এখন, মেনে নিয়ে সব পরাজয়’- এ লাইনগুলো শাফিন আহমেদের কণ্ঠে এক অসাধারণ আবেদন সৃষ্টি করেছিল।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অমর গান
‘আজ জন্মদিন তোমার’, এ গানটি শাফিন আহমেদ ও প্রিন্স মাহমুদের যৌথ প্রতিভার এক অনবদ্য স্বাক্ষর। এটি কেবল একটি গান নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে, একজন শিল্পীর কণ্ঠ যখন একজন স্বপ্নদ্রষ্টার সুর ও কথার সঙ্গে মেশে, তখন তা কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অমর হয়ে যায়।