জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ দেশের মানুষ চেয়েছিল ঐক্যের বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি, হানাহানি বন্ধ হবে। বিভিন্ন দলের মধ্যে যুক্তিতর্ক হবে। রাজনীতিতে বিরাজ করবে এক সৌহার্দের পরিবেশ। ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার তৈরি হবে না। মসনদে বসে কেউ চিরকাল ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন করবে না। আর সে কারণেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সংবিধানসহ রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। গত বছর গঠিত এসব কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। কাজেই এসব সংস্কার কমিটিতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত ছিল। সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলোও এর ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবেনি। তারা সুশীল সমাজের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন যখন রিপোর্ট দেওয়া শুরু করে তখনই আশঙ্কা করা হয়েছিল এ সংস্কার প্রস্তাবগুলো সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জনগণের চাওয়া-পাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করছে না বরং তাদের চিন্তাভাবনা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। শুরুতেই গণমাধ্যম, নারী ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি ওঠে। এসব সুপারিশকে একপেশে ও পক্ষপাতমূলক বলে জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষ করে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে বিতর্কিত কমিশনের সুপারিশগুলো প্রথমেই ছাঁটাই করা হয়। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিত ছিল যে তারা যে সংস্কার বাস্তবায়ন করবে, তা প্রণয়নে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা পালন করা জরুরি। যা হোক, বিতর্কিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাদ দিয়ে বাকি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে একটি চূড়ান্ত সুপারিশ প্রস্তুত করতে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকারের কাছে উপস্থাপন করার পর অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে ঐকমত্য কমিশন।
ছয়টি কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামত সংগ্রহ করে ঐকমত্য কমিশন। এরপর মার্চ মাস থেকে দুই মাস ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনার মাধ্যমে মতামত চূড়ান্ত করা হয়। এর আগে রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনের কাছে ১৬৬টি সুপারিশের ব্যাপারে লিখিতভাবে তাদের মতামত জমা দেয়। জুন মাস থেকে কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে কমপক্ষে ২০টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ ২০টি বিষয়ে দুই মাস ধরে অব্যাহতভাবে আলোচনায় অংশ নেওয়া হয়।
এ প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর খসড়া তৈরি করা হয়। যেখানে সব রাজনৈতিক দলের মতামত সন্নিবেশিত করা হয়।
ড. ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হলেও এর মূল দায়িত্ব পালন করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, আলী রীয়াজ সংবিধান সংস্কার কমিশনেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথমে প্রথিতযশা আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে তিনি রহস্যজনক কারণে এ দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়িয়ে আনা হয় আলী রীয়াজকে। বলে রাখা ভালো, ড. রীয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে লেখাপড়া করেন। ছাত্রজীবনে তিনি বাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডাকসু নির্বাচনে তিনি বাসদের প্যানেল থেকে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর বিবিসিতে সাংবাদিকতা করেন। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ড. রীয়াজ পিএইচডি করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার কারণ হলো, তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ বা আইনজ্ঞ নন, এটা মনে করিয়ে দেওয়া।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর কমিশন একটি চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করে। এ সুপারিশ প্রকাশের পর শুরু হয় বিতর্ক। কথা ছিল, সুপারিশ থেকে সব রাজনৈতিক দল যেসব বিষয়ে একমত হবে কেবল সেগুলোই সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু খসড়ায় দেখা যায়, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি সেসবও সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো যে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছিল তাতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ ছিল। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ কমিশন ২৮ অক্টোবর করেছে তাতে নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই। সংবিধান-সম্পর্কিত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে প্রতিটি প্রস্তাবে একটি নোটে বলা হয়েছে, অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেই মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তফসিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ভিন্নমতের উল্লেখ নেই। আদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ‘আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না।
ভিন্নমতের বিষয়টি কীভাবে রাখা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশন যে বিষয়গুলোকে তফসিলের মাধ্যমে সংযুক্ত করে আদেশ দেওয়ার কথা বলছে, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো কোনো দলের কিছু কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে। কিন্তু কমিশন জনগণের সম্মতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। কমিশন যে ৪৮টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে জনগণের সম্মতি বা অসম্মতির বিষয়টিকে কমিশন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
স্পষ্টতই এটা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। আলোচনার বাইরে, কমিশন জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে পারে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। বিশেষ করে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো কেন সবার অলক্ষ্যে ঢোকানো হলো তা এক রহস্য।
২৮ অক্টোবরের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ এবং বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
দেশ যখন একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ঐকমত্য কমিশনের এ সুপারিশ সচেতন মানুষকে হতবাক করেছে। এ ঘটনা জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। নির্বাচন নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে বিএনপি এ সুপারিশের ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে উপায়-সম্পর্কিত যেসব সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জমা দিয়েছে তাতে চরম ক্ষুব্ধ বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সদস্যরা বলেছেন, এটি ঐক্যের বদলে জাতীয় অনৈক্য তৈরির চেষ্টা বলেই মনে হয়েছে। জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সুপারিশের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গণভোটের প্রস্তাব অবান্তর।
এমনিতেই দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। নির্বাচন বানচালের নানা ষড়যন্ত্র চলছে। তার মধ্যে কেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিল?
কমিশনের কেউ কেউ কি তাহলে চান না দেশে নির্বাচন হোক? সরকারের ভিতরে একটা মহল নির্বাচন না করে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী। আমাদের সুশীল সমাজের একটি অংশ সব সময় গণতন্ত্রবিরোধী। দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চায়। এই সুশীল গোষ্ঠী রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে দেশে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল ২০০৭ সালে। রাজনৈতিক বিভেদ আর সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এসেছিল এক-এগারোর সরকার। বাংলাদেশে আবার কি সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে কোনো কোনো মহল? এজন্যই কি তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে জুলাই সনদকে?
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        