জুলাই বিপ্লবের পর থেকে নানানরকম সংকেতের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৫ মাস কেটে গেল। অথচ শনি বা রাহুর কবল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন বিভাজন তৈরি হলো। সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা জোয়ারে মাটির বাঁধ ভাঙার মতো। একদিকের বাঁধ মেরামত করলে অন্যদিকে ভেঙে যায়। রাজনীতির শতধা শক্তিগুলো একত্র করে মহাশক্তিতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেও বারবার শক্তিগুলো অপশক্তিতে রূপ নিচ্ছে। প্রকাশ্য এবং গুপ্ত নানান অপশক্তি আমাদের শুভযাত্রা বিঘ্নিত করছে। অন্তর্বর্তী সরকার মোটাদাগে ফ্যাসিস্টের বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। সরকারপ্রধান যাঁদের পছন্দ করে, ‘বিশ্বাস করে’, ভালোবেসে নিজের সঙ্গে নিয়েছেন তাঁদেরই অনেকের কর্মকাণ্ড সরকারকে বিব্রত করছে। নির্মোহভাবে বললে বলতে হয়, অনেকেই বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করছেন। সে কারণেই এনসিপি নেতারা বলছেন, উপদেষ্টাদের অনেকে সেফ এক্সিট খুঁজছেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আরও একটি বিস্ফোরক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে। অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন।’ তথ্য উপদেষ্টা সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তথ্য উৎপাদন, বিতরণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ সবই তিনি করেন। তিনি না চাইলেও তাঁর কাছে স্রোতের মতো তথ্য ভেসে ভেসে চলে যায়। তিনি সরকারেরও তথ্য সংরক্ষণ করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর তথ্যও তাঁর গোচরে থাকে। সে কারণে তাঁর এ বক্তব্য আগামী দিনের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী নির্বাচন হলো এখন একমাত্র ও সর্বশেষ এজেন্ডা। ফেব্রুয়ারিতে সেই নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার জোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনের আছে আর সাড়ে তিন মাস। তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করতে সবাই যদি মুখিয়েই থাকে, তাহলে বাধাগ্রস্ত হবে নির্বাচন। দেশে গণতন্ত্র হবে সুদূরপরাহত। বিজয়ী হতে না পারলে নির্বাচনের দরকার নেই, এমন রাজনৈতিক খেলা যারা খেলতে চাচ্ছেন, তাদের বিজয় হবে। তাহলে কি মেজর জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূইয়ার ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হবে? যদি তাই হয়, তাহলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এমন অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ক্ষমতালোভী, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী চক্রের মুখোশ দেশবাসীর কাছে স্পষ্টভাবে উন্মোচন করতে হবে।
কোনো পথচারী রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেলে, যতবার ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটে, ততবার ওই স্থানটি ও হোঁচট খাওয়ার স্মৃতি তার মনে পড়ে। রাজনীতিতে সেই স্মৃতি আরও বেশি প্রকট হয়। রাজনীতির খেলায় ব্যর্থ হলে অনুশোচনা হয়, আর পরাজিত হলে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগের সন্ধান করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়। সেই নির্বাচনে ষড়যন্ত্র বুঝতে না পারা ছিল বিএনপির সবচেয়ে বড় ভুল। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫-এর পর ’৯৬-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ দলের ভিত শক্ত করে। এর ওপর ভর করেই
২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে শেখ হাসিনার সরকার। রাজনীতির হিসাব কষলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসতে না পারত, তাহলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা দখলে রাখতে পারত না। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বিনা শর্তে ক্ষমা চেয়েছেন। ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন (কোবা)’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেন। এ সময় বলেন, ‘সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আজ ২২ অক্টোবর রাত ৮টা ১১ মিনিট পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, আমরা বিনা শর্তে তাদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই। কোনো অসুবিধা নাই।’ তাঁর এ বক্তব্য রাজনীতিতে কিছুটা হলেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আবার অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কেন এবং কাদের কীভাবে কষ্ট দিয়েছে সেটা তাদের নেতা-কর্মীরা ভালো জানেন এবং বলতে পারবেন। আর জানেন মুক্তিযোদ্ধারা। আরও জানেন স্বজনহারা, সম্পদহারা, সম্ভ্রমহারা নিরীহ মা-বোন, জনগণ, যাদের চোখে-মুখে এখনো সেই ভয়াল দৃশ্য ভেসে ওঠে। ডা. শফিকুর রহমানের আগে অধ্যাপক গোলাম আযম এবং মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীও ক্ষমা চেয়েছিলেন। দলের প্রধান হিসেবে তৃতীয় ব্যক্তি দেশবাসীর কাছে এবার ক্ষমা চাইলেন। নির্বাচনের আগে এভাবে ক্ষমাপ্রার্থনার পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ক্ষমা চাওয়ার পর দেশে-বিদেশে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তাঁদের অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন জেগেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান যদি জয়ী হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা ছিলেন, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সহযোগী, স্বজনহারা, স্বামী-সম্ভ্রমহারা মা-বোন রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি থেকে রেহাই পেতেন কি না? তাঁরা ক্ষমা চাইলে পাকিস্তান সরকার বা তাদের সহযোগীরা ক্ষমা করত কি না? তার পরও ক্ষমার তো একটি শক্তি আছে। সেই শক্তির বলে আগামী নির্বাচনে দেশের মানুষ যদি জামায়াতকে ভোট দেয় তা হবে তাদের উদারতা। আর জনগণের ভোট নিয়ে জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসতে পারে, সেটা হবে তাদের কষ্টার্জিত অর্জন এবং চূড়ান্ত সৌভাগ্য।
রবীন্দ্রনাথ গানের কথায় বলেছেন, ‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোন কথা না বলি। তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।’ কবির সঙ্গে তাঁর তিন বছরের নাতনি নন্দিনী দুষ্টুমি করছিল, কবির সঙ্গে অনেক কথা বলছিল। কিন্তু কবি দাদু তার কথা বুঝতে পারছিলেন না। ৬৪ বছরের কবি তখন তাঁর নাতনিকে উদ্দেশ করে এ গানটি রচনা করেছিলেন। আমাদের তথ্য উপদেষ্টা ইদানীং অনেক কথাই বলছেন। কোনো কথাই না বোঝার নয়। সে কারণে না বোঝার আশাও আমরা জলাঞ্জলি দিতে পারি না। তিনি যা বলার স্পষ্ট করে বলছেন। দেশবাসী স্পষ্টভাবে বুঝতেও পারছে। শুধু বুঝতে পারছে না ক্ষমতালোভী কিছু দল। যাদের কাছে ক্ষমতাই প্রথম, ক্ষমতাই শেষ। মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে এবং আপনারা অবশ্যই এটা অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন এবং আমি আশঙ্কা করছি, যদি এটার সঙ্গে ধর্মীয় যে দৃষ্টিকোণ, এটা যদি যুক্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ আগামী নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কার কথা তিনি বলে দিয়েছেন। সরকারের একজন উপদেষ্টা যখন এমন ইঙ্গিত দেন তখন বুঝতে হবে নির্বাচন বানচালের জন্য খেলোয়াড়রা মাঠে নেমে গেছে। এ খেলোয়াড় তারা, যারা মনে করে ক্ষমতা নিশ্চিত না হলে আপাতত নির্বাচন দরকার নেই। তথ্য উপদেষ্টার মতো একই ইঙ্গিত দিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়া। তিনি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক-দুই বছর থাকবে।’ সুতরাং কী হতে যাচ্ছে বা কেন হতে যাচ্ছে তা আস্তে আস্তে সবার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন দুটি ধারার রাজনীতি নিজস্ব গতিপথ তৈরি করছে। একটি ধর্মভিত্তিক, অন্যটি ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। ধর্মীয় মূল্যবোধ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রবর্তক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালে তাঁর শাহাদাতের পর আপসহীন নেতৃত্বের আদর্শে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একমাত্র ঠিকানায় পরিণত হন বেগম খালেদা জিয়া। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানে সব মতপথের মানুষের কাছে ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। একজন গৃহবধূ থেকে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র সমুন্নত রেখেছেন। দেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য কারাবরণ করেছেন। এক সন্তান আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। আরেক সন্তান তারেক রহমানের কষ্টকর দেশান্তরী জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। বিদেশে থেকেও তারেক রহমান দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঐক্য ধরে রেখেছেন। গত ১৬ বছরে বিএনপি ধ্বংসের জন্য হাসিনা সরকার এমন কোনো কাজ নেই যা করেনি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। এখনো বিএনপি নেত্রী সবার কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। সে কারণেই রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বেগম জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংকটে বেগম খালেদা জিয়া এখনো ঐক্যের প্রতীক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দলটি পরিচালনা করছেন। ফ্যাসিবাদমুক্ত একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট ফিরে আসতে পারে সেই শঙ্কা থেকেই ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড় না থেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী এখন চলছে তাঁদের সর্বশেষ কাজটি সম্পন্ন করার প্রস্তুতি। সেই কাজটি হলো একটি নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। দেশবাসীও এটি চায়। উপদেষ্টারাও অবশিষ্ট আত্মসম্মান নিয়ে বিদায় নিতে চান। এমন সময়ে নির্বাচন বানচাল অথবা সংঘাত সৃষ্টির অপচেষ্টা সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ‘ক্ষমতা নিশ্চিত না হলে নির্বাচন নয়’, এমন এজেন্ডা নিয়ে একটি মহল ভিতরে ভিতরে তৎপর হচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অনৈক্য সৃষ্টিকারী কিছু সুপারিশ। গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র একসঙ্গে শক্তি সঞ্চয় করছে। সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একমাত্র তারেক রহমানকেই ঐক্যের ডাক দিতে হবে। প্রতিবাদী কৃষক নেতা নূরলদীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এক ডাকে কেঁপে উঠেছিল ইংরেজের শোষণ-লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের আসন। দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের ইজারাদার। যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে নূরলদীনের মতো একমাত্র তারেক রহমানকেই এখন বজ্রকণ্ঠে ঐক্যের ডাক দিতে হবে- ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন