‘আসমানী’ কবিতায় অসহায় এক নারীর জীবনগাথা এঁকেছিলেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। আজ কবির নিজেরই পুত্রবধূ বাড়ি হারানোর আতঙ্কে আছেন। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, বেহাত হতে বসেছে কবির পৈতৃক সম্পত্তি, সেই সঙ্গে ধূলিসাৎ হতে চলেছে কবির মেজো ছেলে জামাল আনোয়ারের ‘কবি জসীমউদ্দীন শিক্ষানিকেতন’ গড়ার স্বপ্ন।
কবিপুত্র জামাল আনোয়ারের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানার এই অভিযোগ সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ ও তাঁর ভাই বিলাল হোসেনের বিরুদ্ধে।
কবির পুত্রবধূ স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর জন্যও আজাদ পরিবারের দখল-নৈরাজ্যকে দায়ী করছেন। রাজিয়া সুলতানা বলছেন, ওয়ারিশি মালিকানার জটিলতার সুযোগ নিয়েছে এ কে আজাদের পরিবার। কবিপুত্র গত ডিসেম্বরে মারা যান। তিনি বলছেন, এ কে আজাদের লোকজনের বাধার কারণে শহরের অনাথ মোড়ে নির্মিত বাড়িতে উঠতে না পেরে দুই শিশুসন্তান মধুমালা জসীম উদ্দীন ও নকশী আনোয়ার জসীম উদ্দীনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, জামাল আনোয়ারের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে আন্ড্রে আনোয়ারকে ব্যবহার করে আরো সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে দখলদারচক্র। এখন দুই সন্তান নিয়ে নিজেকে আরো বিপন্ন বোধ করছেন রাজিয়া সুলতানা।
এ কে আজাদ পরিবারের হয়রানি থেকে মানসিক চাপে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে—এমনটাই অভিযোগ রাজিয়া সুলতানার। তিনি বলেন, ‘আমার সাহেবটা এত বড় নামি-দামি লোক, সে সাধারণ একটা এ কে আজাদ...সে তার মতো লোকের কাছে যাইয়া অসম্মানী হয়ে আসল বা অসম্মানী হয়ে সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করল, এইটা আমার জন্য অনেক কষ্টদায়ক...!’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিরোধের মূলে ফরিদপুরের ‘অনাথের মোড়’ এলাকায় পল্লীকবির রেখে যাওয়া ৫০.৯০ শতক প্লট। ড. আনোয়ার পৈতৃক জমিতে ‘কবি জসীমউদ্দীন শিক্ষানিকেতন’সহ একটি দাতব্য হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ কে আজাদের ভাই বিলাল হোসেন পল্লীকবির ছোট মেয়ের কাছ থেকে মালিকানার অংশবিশেষ কিনে পুরো প্লট দখলের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিক্রি করা অংশ ফিরে পেতে কবিপুত্র এ কে আজাদের কাছে ধরনা দিয়েও সমাধানে রাজি করাতে পারেননি। গত বছর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান।
রাজিয়া সুলতানার অভিযোগ, কবির ছোট মেয়েকে (জামাল আনোয়ারের স্ত্রীর ননদ) জমির প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে কম দামে বিক্রি করতে প্ররোচিত করা হয়। রাজিয়া সুলতানা এই ঘটনাকে স্রেফ ‘ভূমিদস্যুতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
পৈতৃক জমি রক্ষায় জামাল আনোয়ার প্রি-এমশন (অগ্রক্রয়) মামলা করেন বলে জানান তিনি। এরপর আদালতে ‘সোলেনামা’ (আপস চুক্তি) চূড়ান্ত হয়, যা কোনো কাজে আসেনি। রাজিয়া সুলতানার ভাষ্য, সোলেনামা অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের অংশে ঘর তুলতে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আজাদের ভাই বিলাল ৫০ থেকে ১০০ জন লোক নিয়া আইসা বাধা দেয়। আমার সাহেব ও মিস্ত্রিরে ধাক্কা দেয়।’
এ ঘটনার পর তাঁদের কাজ বন্ধ হয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর্সেনিকের ওপর ডক্টরেট করা, কবি জসীমউদ্দীনের ছেলের মতো একজন মানুষকেও বিচারের আশায় এ কে আজাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হয়েছে।’
ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি এ কে আজাদের সহোদর ভাই বিলাল হোসেনের বিরুদ্ধে ‘পল্লীকবি জসীমউদ্দীন শিক্ষানিকেতন’-এর জমি জবরদখলের অভিযোগে গত বছরের ২০ জুন মানববন্ধন করে কবি পরিবার ও এলাকাবাসী। এ সময় জানানো হয়, এ কে আজাদ কবি পরিবারকে জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
এ কে আজাদের হুমকির অভিযোগ:
জেলা প্রশাসককে মাধ্যম করে ফরিদপুর প্রেস ক্লাবকে দেওয়া এক বিবৃতিতে রাজিয়া সুলতানা লেখেন, ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার কমলাপুর মৌজায় দুই দাগে ৫০.৯০ (৩১.৩৪ ও ১৯.৫৬) শতাংশ ভূমির মধ্যে ১৯.৫০ শতাংশ ভূমির মালিক কবিপুত্র ড. জামাল আনোয়ার। যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালত থেকে দেওয়ানি মামলা ২৬/২০১৭-এর বিপরীতে জমি মালিকের পক্ষে আদেশ রয়েছে (২৮, ০৩/০১/২০২২)। এ ছাড়া কবিপুত্র বিলালের বিরুদ্ধে সহকারী জজ আদালত ফরিদপুরে মামলা করেছেন, যা বিচারাধীন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আসামিপক্ষ ফরিদপুর সদর আসন-৩-এর এমপি এ কে আজাদের সহোদর ভাই মো. বিলাল হোসেন তাঁর ভাইয়ের ক্ষমতাবলে শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে ১৬ জুন কবিপুত্রের জমি জবরদখল করতে যান। খবর দেওয়া হলে পুলিশ জমি জবরদখল প্রতিহত ও বাউন্ডারি নির্মাণ বন্ধ করে দেয়। পুলিশ চলে যেতেই বিবাদী বেলাল আবারও শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে এসে জমি দখলের চেষ্টা চালান। রাজিয়া সুলাতানা বিজ্ঞপ্তিতে লেখেন, ‘বিষয়টি আমি ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি এ কে আজাদ সাহেবকে অবগত করিলে তিনিও আমাকে জায়গা বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি প্রদান করেন।’
মামলার নথি মতে, ফরিদপুরের ১১৬ নম্বর কমলাপুর মৌজার ৭০৩ নম্বর দাগে মোট ৫০.৯০ শতাংশ ভূমি ছিল, যার মধ্যে কবি জসীমউদ্দীন আহমদ ১ আনা অংশের মালিক ছিলেন। কবির মৃত্যুর পর তাঁর চার পুত্র, দুই কন্যা ও স্ত্রী ওয়ারিশ হিসেবে সম্পত্তি পান। কবির সন্তান কামাল আনোয়ার ও স্ত্রী মমতাজ বেগমও মারা গেলে তাঁদের অংশ অন্য ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টিত হয়। এই হিসাবে বাদী জামাল আনোয়ার মোট ১০.৫০ শতাংশ মালিকানা পান। অন্য দুই বাদী জামাল আনোয়ারের প্রয়াত ভাইয়ের সন্তান। তবে জার্মানিপ্রবাসী বলে তাঁরা কাকা জামাল আনোয়ারকে সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করেন। এই হিসাবে তিনজনের মালিকানা মিলে জমি ছিল ১৯ শতাংশের মতো।
মামলার নথিতে দেখা যায়, কবিপুত্রের বণ্টন মামলার পর পক্ষে রায় পেয়ে এই সম্পত্তিতে ভবন তৈরি করে তাঁরা ভোগ-দখল করছিলেন। কিন্তু গত বছরের ১৫ এপ্রিল বিবাদীরা ঘরদোর ভেঙে ফেলে এবং দখল ছাড়তে হুমকি দেয়। এরপর জামাল আনোয়ার বিবাদীদের এ ধরনের বেআইনি কাজ থেকে বিরত রাখতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবারও আদালতের শরণাপন্ন হন। তবে সেই রায় জামাল আনোয়ার দেখে যেতে পারেননি।
ছেলের মৃত্যুতে নতুন মোড় :
কবির পুত্রবধূর তথ্য মতে, তাঁর স্বামীর আরেক স্ত্রী জার্মানিপ্রবাসী। তাঁর সন্তান আন্ড্রে আনোয়ার (৪৮) অসুস্থ ছিলেন। গত বছর বাবার মৃত্যুর সময় অ্যান্ড্রে বাংলাদেশেই ছিলেন এবং তাঁর শারীরিক গুরুতর জটিলতা চলছিল। কবিপুত্রের মৃত্যুর পর আন্ড্রেকে কবির আরেক পুত্র খোরশেদ আনোয়ারের মাধ্যমে ঢাকায় আনায় এ কে আজাদের লোকজন। অসুস্থ ও সহজ-সরল অ্যান্ড্রে কিছু না বুঝে নিজের ভাগের জমি তাদের লিখে দেন। এরপর জার্মানি ফিরে গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান আন্ড্রে।
কবির পুত্রবধূ বলেন, ‘এই যে জমিটা এ কে আজাদরা কিনল, এটা তো আমার কাছে একটু শোনার দরকার ছিল। হঠাৎ কইরা শুনি যে জায়গা সে বিক্রি করছে। ছেলেটা ছিল বিদেশি। ও তো বাংলা ভাষা বুঝত না, টাকা চিনত না। ওয়ারিশ কী বুঝত না। অসুস্থ ছিল বলে কেউ চাইলেই পকেটে যা থাকত দিয়ে দিত।’
এখন কবিপুত্রের তৈরি দালানবাড়ির জায়গাটা এ কে আজাদের ভাই দখলে নিতে চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ছেলেরটা বিক্রি করছে হয়তো ৪ শতাংশ। আরো ৫ শতাংশের বেশি আমার থাকার কথা। তো সেখানে সেই ফাঁকা জায়গা আছে। সেই ফাঁকা জায়গাটা তারা নেবে না। তাদের লোভ আমার বিল্ডিংটার উপরে।’
জামাল আনোয়ারের স্ত্রীর আরো অভিযোগ, ‘গত কোরবানির ঈদের ছুটির সময়, যখন আদালত বন্ধ, আমার বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি ভাঙছে। পুলিশ আইসা দাঁড়াই রইছে। পুলিশের সামনে এই কাজটা করছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর ভাইরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা হয় এবং ‘গায়ে হাত’ তোলা হয়।
ভবনের রাস্তা আটকে দেয়াল :
রাজিয়া অভিযোগ করেন, তিনি মেয়েদের নিয়ে নতুন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, বাড়ির সামনে এ কে আজাদের লোকজন প্রাচীর নির্মাণ করেছে। এতে বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের প্রবেশপথ। প্রতিবেদক সরেজমিনে এই দৃশ্য দেখতে পেয়েছে। সত্যতা মিলেছে প্রতিবেশীদের বক্তব্যেও।
প্রতিবেশী শাফিয়া বেগম বলেন, ‘তারে (কবির পুত্রবধূ) উঠতে মানা করেছে আমরা দেখেছি। কিন্তু তার তো ছেলে নাই যে সামনে দাঁড়াবে।’
এ কে আজাদের লোকজনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘ঘরের ভিতর দিয়া ড্রেন কাটছে, নালি কাটছে, কল টাইনা উঠাই ফালাইছে।’
‘কবি সাহেবের ছেলে বিল্ডিং কইরাও উঠতে পারে না,’ আক্ষেপ করে বলেন প্রতিবেশী হামিদা।
শিউলি জাহান বলেন, ‘ডক্টর জামাল আনোয়ারের ইচ্ছা ছিল বাবার নামে কিছু করার। কিন্তু প্রভাবশালী এ কে আজাদের লোকজন, উনার ভাই, বিলাল, উনারা জায়গা দখল কইরা নিতে চাইতাছে।...শুনছি উনাদের ক্ষমতা অনেক। দুই মেয়ে নিয়া জামাল আনোয়ারের স্ত্রী উঠতে গেছিল। ও উঠতে দেয় নাই। তারা সামনে দিয়া ওয়ালও গাঁইথা দিছে। উনাদের অনেক ক্ষমতা। ক্ষমতার কাছে অসহায় মানুষ হাইরা যায়।’
আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘তারা দুই টাকা দিল, আর কইল সব টাকা দিয়া আমরা দলিল করছি। কিন্তু এইটা তো মিথ্যা। এ কে আজাদ যদি সম্পূর্ণ টাকা দিয়া কিনত, সে তো দলিল করত। দলিল দেখাইত। বাসু (জামাল আনোয়ার) সাহেব তো দলিল দেয় নাই। তার ছোট ভাই (খোরশেদ আনোয়ার) আধাপাগলা। ব্রেনের ঠিক নাই। যা মনে হয় করতে পারে। তার কথার কোনো মূল্য নাই।’
এ ব্যাপারে অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সূত্র: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজিম