বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। দীর্ঘদিন ধরে এ খাতের উল্লেখযোগ্য অংশ সংগ্রহ করে আসছিল দেশের শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। মাত্র ১৬ মাসে রেমিট্যান্স বাজারে তাদের শেয়ার প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো যেখানে মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের ৫১ দশমিক ৫৭ শতাংশ সংগ্রহ করেছিল, ২০২৫ সালের মে মাসে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশে। অর্থাৎ অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ চলে গেছে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে।
সম্পূর্ণ ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামিক ব্যাংক শাখা ও ইসলামিক উইন্ডো মিলে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছিল। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও তাদের শেয়ার ছিল ৪৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ক্রমাগত পতন শুরু হয়, যা অব্যাহত থেকে চলতি বছরের মে মাসে সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছায়। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ইসলামী ব্যাংকগুলো সংগ্রহ করেছিল ৭৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০২৫ সালের মে মাসে এসে তা কমে দাঁড়ায় ৬৬ কোটি ডলারে। অন্যদিকে প্রচলিত ব্যাংকগুলো একই সময়ে ১১৭ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে। ফলে রেমিট্যান্স বাজারে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে তারা। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুশাসনের অভাব ও দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য, কিছু ইসলামিক ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে সুশাসনের সংকটে ভুগছে। পরিচালনা পর্ষদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। তারল্য ঘাটতি রেমিট্যান্স নিষ্পত্তি করতে পর্যাপ্ত তারল্য দরকার হয়। কিন্তু কিছু ইসলামিক ব্যাংকের হাতে তা নেই, ফলে তারা কার্যত রেমিট্যান্স লেনদেন কমিয়ে দিয়েছে বা বন্ধ করেছে। এ ছাড়াও আস্থার সংকট প্রবাসী শ্রমিক ও বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এখন প্রচলিত ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। কারণ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভরযোগ্যতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
প্রচলিত ব্যাংকের প্রতিযোগিতা প্রচলিত ব্যাংকগুলো ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা, দ্রুত লেনদেন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-সহায়তা কাজে লাগিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে এগিয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যদি ইসলামিক ব্যাংকগুলো সেবার মান উন্নত, প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যাংকিং সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে (কমপ্লায়েন্স) নিজেদের শক্ত না করে, তাহলে রেমিট্যান্স খাতে তাদের ভূমিকা আরও কমে যেতে পারে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ সাধারণত নির্ভর করে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা, উৎসব ও বিশেষ মৌসুম, সরকার ও ব্যাংকের প্রণোদনা, ব্যাংকের অবস্থান ও সহজ সেবা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গ্রাহকের আস্থা ও ব্যাংক নির্বাচনের ওপর। আর এখানেই ইসলামিক ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রচলিত ব্যাংকগুলো এখন ইসলামিক ব্যাংকের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহে। কিছু ইসলামিক ব্যাংক কার্যত এ খাতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা হয়তো রেমিট্যান্স কার্যক্রম বন্ধ করেছে বা ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স নিষ্পত্তির মতো তারল্যও নেই তাদের।
তার মতে, শুধু তারল্য সংকট নয়, আস্থার ঘাটতিও ইসলামিক ব্যাংকের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রবাসীরা নিরাপদ মনে করে প্রচলিত ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন। যদিও ইসলামিক ব্যাংকগুলো এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে, তবে ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এ খাতে তাদের আধিপত্য হারানোর শঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে রেমিট্যান্স বাজারে ইসলামিক ব্যাংকের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ, সেবা দ্রুত ও সহজ করা, গ্রাহক আস্থা পুনরুদ্ধার, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা ও স্বচ্ছতা ও সুশাসন জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় খাত রেমিট্যান্স। এ খাতে ইসলামিক ব্যাংকের দীর্ঘদিনের আধিপত্য এখন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আস্থার সংকট, দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য ও সুশাসনের ঘাটতি কাটিয়ে না উঠলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো শুধু বাজার হারাবে না, বরং দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে প্রবাসী আয় আহরণে ইসলামিক ব্যাংকগুলো আবারও তাদের পুরোনো অবস্থান ফিরে পায়।