দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন মানেই ছিল অসংখ্য কাগজপত্র, ফাইল ঘোরানো আর দীর্ঘসূত্রতা। কোনো প্রকল্প প্রণয়ন থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন ও একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) পর্যন্ত যে সময়, অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় হতো, তা নিয়ে দীর্ঘদিন সমালোচনা ছিল। এবার সেই চিত্র বদলাতে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ চালু করেছে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রজেক্ট প্রসেসিং, অ্যাপ্রেইজাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (পিপিএস)। এর মাধ্যমে সরকারি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, মূল্যায়ন এবং অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়াই হবে অনলাইনে, কাগজবিহীন বা পেপারলেস পদ্ধতিতে।
কেন দরকার হলো এ প্ল্যাটফর্ম : বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এসব প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রকল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়ে যায় এবং সময়মতো কাজ শেষ হয় না। আবার কোনো প্রকল্পের আর্থিক বা ভৌগোলিক প্রভাব বোঝার মতো সমন্বিত ডেটাবেজও ছিল না। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সময় ও ব্যয় কমানো, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।
চার সফটওয়্যারের সমন্বিত ব্যবস্থা : ‘স্ট্রেনদেনিং ডিজিটাল প্রসেসিং অব প্রজেক্টস (এসডিপিপি)’ নামের একটি উদ্যোগের আওতায় চারটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হলো; পিপিএস : ডিপিপি প্রস্তুত, মূল্যায়ন ও অনুমোদনের সম্পূর্ণ অনলাইন প্রক্রিয়া। জিআরএম : মানচিত্রভিত্তিক তথ্যের মাধ্যমে প্রকল্পের অবস্থান ও প্রভাব দৃশ্যমান করবে। এনপিএম : দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ। আরএমএস : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গবেষণার তথ্য থেকে অন্তর্দৃষ্টি বের করবে। এ চারটি সফটওয়্যারকে বিদ্যমান ই-সেবা ও প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পের অর্থায়ন, সময়সীমা, বাস্তবায়ন অগ্রগতি সবই এক প্ল্যাটফর্ম থেকে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হবে।
পরিবর্তনের প্রথম সাফল্য : গত এপ্রিল মাসে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় প্রথম কোনো প্রকল্প অনুমোদিত হয় তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে দুটি গভীর অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্প। এটি পুরোপুরি অনলাইনে তৈরি হয়ে একনেকে উপস্থাপন করা হয় এবং অনুমোদন পায়। কর্মকর্তাদের মতে, এটাই বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল যুগে প্রবেশের প্রকৃত সূচনা।
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে : তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। অনেক সরকারি কর্মকর্তা এখনো হাতে-কলমে কাজ করার অভ্যাসে অভ্যস্ত, ডিজিটাল প্রক্রিয়া গ্রহণে অনীহা আছে। প্রশিক্ষণের ঘাটতিও এক বড় সমস্যা। পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নুরুন নাহার বলেছেন, ‘প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত সব কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ শেষ হলে পুরো প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হবে।’
নতুন নীতিমালা ও বাধ্যবাধকতা : চলতি অর্থবছরের এডিপিতে তালিকাভুক্ত ১ হাজার নয়টি অনুমোদনবিহীন প্রকল্পের মধ্যে ৭০৩টি ইতোমধ্যে পিপিএসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নতুন কোনো প্রকল্প কমিশনে পাঠানোর আগে অবশ্যই পিপিএসে আপলোড করতে হবে। পিপিএস ছাড়া কোনো প্রকল্প অনুমোদনের ধাপে অগ্রসর হতে পারবে না। এ বিষয়ে মার্চে প্রোগ্রামিং বিভাগ নির্দেশনা জারি করেছে কমিশন।
ব্যয় ও সময়সীমা : ২০১৯ সালে ৩৭ কোটি টাকায় শুরু হওয়া এসডিপিপি প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। প্রথমে ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। সম্ভাবনা : স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা : প্রকল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় প্রকল্প অনুমোদনের ফলে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পে সময়মতো অর্থ ছাড় সম্ভব হবে। এর ফলে ব্যয় সাশ্রয় হবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি বাড়বে। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রক্রিয়াকরণ এত দিন ছিল আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জর্জরিত। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম পিপিএস সেই চিত্র বদলাতে পারে। তবে এর সফলতা নির্ভর করছে সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিকতা, দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর। সব বাধা কাটিয়ে যদি নতুন সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর হয়, তবে দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় এটি হবে এক ‘গেম চেঞ্জার’।