চীনা সৈন্যরা অরুণাচল সীমান্ত থেকে পাঁচজন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিককে গত সপ্তাহে অপহরণ করে নিয়ে গেছে বলে ভারত অভিযোগ করার পর ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবার বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
শনিবার ৫ সেপ্টেম্বর অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের একজন রাজনীতিক ও ভারতীয় লোকসভার সদস্য প্রথম এই অভিযোগ আনেন এক টুইট বার্তায়।
এই রাজনীতিক তাপির গাও অভিযোগ করেন যে তেসরা সেপ্টেম্বর সীমান্তের কাছে চীনা সৈন্যরা স্থানীয় পাঁচজন ভারতীয়কে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অরুণাচল প্রদেশের একজন কংগ্রেস নেতা নিনং এরিং-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, স্থানীয় ওই যুবকরা সেনাবাহিনীর মালামাল বহন করার কাজ করত বলে জানা যাচ্ছে।
এই ঘটনার পর ভারতের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু বলেছেন ভারতীয় সেনা বাহিনী চীনা সেনা বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির কাছে "হটলাইন মেসেজ'' পাঠিয়ে এর উত্তর চেয়েছে। চীনের কাছ থেকে তারা উত্তরের অপেক্ষা করছেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
স্থানীয় খবরে বলা হচ্ছে, এই পাঁচজন শিকারের উদ্দেশ্যে প্রত্যন্ত একটি পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলেন যেখানে সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়নি। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান আরও বলেছেন, অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের অংশ বলেই মনে করে। তিনি বলেছেন ''অরুণাচল চীনের দক্ষিণ তিব্বত অঞ্চলের অংশ''।
চীন এখনও ভারতের ''হটলাইন বার্তার'' উত্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও এই অভিযোগ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আবার বাড়ছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অগাস্ট মাসে সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা বাড়াতে চীন দু দুবার প্ররোচনা জুগিয়েছিল বলে ভারত অভিযোগ করেছিল। চীন দুবারই ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ৫ সেপ্টেম্বর মস্কোর এক বৈঠকে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে এই অপহরণের অভিযোগ তোলেন। ওই বৈঠক অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের পথ তৈরি করা এবং দুই দেশের সম্পর্কে বরফ গলার প্রস্তুতি নেয়া।
কিন্তু এই অপহরণের অভিযোগের পর দুই দেশের মধ্যে আবার নতুন করে বাক যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
চীন বলেছে, সীমান্ত নিয়ে অচলাবস্থার জন্য "পুরোপুরি" ভারত দায়ী, এবং চীন "তাদের ভূখন্ডের এক ইঞ্চিও" জায়গা ছেড়ে দেবে না।
ভারত অভিযোগ করে চীন "সীমান্ত এলাকায় বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করছে, আগ্রাসী আচরণ করছে এবং একতরফা ভাবে সীমান্ত পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করে প্ররোচনা সৃষ্টি করছে"।
লাদাখ সীমান্তে ১৫ই জুন রাতে চীন ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দুই দেশের চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রী অর্থাৎ দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা ৫ই সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মত মুখোমুখি হয়েছিলেন মস্কোতে।
যদিও দুই বৈরি দেশের মধ্যে জুনের পর নতুন করে কোন সংঘাত হয়নি, কিন্তু সীমান্তে এরপরও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে এবং বিশ্লেষকরা বলছেন সীমান্তের পরিস্থিতি জুনের পর থেকে খুবই নাজুক অবস্থায় আছে।
জুন মাসে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে বিশ জন ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। চীনা পক্ষেও হতাহতের খবর দেয়া হয়েছে অসমর্থিত সূত্রে। তবে চীন কোন হতাহতের খবর নিশ্চিত করেনি।
দুই দেশই নিয়মিত ভাবে লাদাখ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার কারণে সেখানে সীমানা খুব নির্দিষ্টভাবে চিহ্ণিত না থাকায় দু্ পক্ষই পরস্পরের সীমানা লংঘনের অভিযোগ আনায় সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয় প্রায় নিয়মিতই।
দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েক দফা কূটনৈতিক ও সেনা পর্যায়ে বৈঠক হলেও পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত ও চীন তাদের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের সীমান্ত বিবাদ মেটাতে কখনই সফল হয়নি।
জুন মাসের ঘটনা
জুন মাসে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল দুই দেশের সেনা বাহিনী প্রায় ১৪ হাজার ফুট উঁচু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং লড়াইয়ের সময় কিছু ভারতীয় সৈন্য খরস্রোতা গালওয়ান নদীতে পড়ে যায়। গালওয়ানের তাপাঙ্ক ছিল শূণ্যের নিচে।
খবরে বলা হয় বিশজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়া ছাড়াও অন্তত ৭৬ জন সৈন্য আহত হয়েছে। চীনের দিকে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল কিনা সে বিষয়ে কোন তথ্য চীন প্রকাশ করেনি।
ওই বিতর্কিত অঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিস্ফোরকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কারণে জুনের ওই সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ যে কারণে
চীন-ভারত সীমান্তে অবস্থিত বিতর্কিত গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি বলে আসলে সেভাবে কিছু নেই। এই নিয়ন্ত্রণ রেখা ওই এলাকার দুর্গম ভৌগলিক অবস্থানের কারণে কখনই ভালভাবে চিহ্ণিত করা হয়নি। সেখানে নদী, ও হ্রদ থাকায় এবং বরফ-আবৃত এলাকা থাকার ফলে কোন সীমানা রেখা স্থায়ী হবে এমনটাও নয়। এসব কারণে সীমারেখা সরে যাওয়ারও ঝুঁকি থাকে।
ফলে বিভিন্ন সময়ে দুপক্ষের সেনারা বিতর্কিত এই সীমানার বহু জায়গায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
ভারত অভিযোগ করে চীন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে এবং ওই এলাকার ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা চীন দখল করে আছে।
গত তিন দশক ধরে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেও এই বিতর্ক সমাধানে দুই দেশ ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে ১৯৬২ সালে একটা যুদ্ধও হয়ে গেছে যে যুদ্ধে বিপর্যয়কর ভাবে পরাজিত হয় ভারত।
সম্প্রতি আবার উত্তেজনা বৃদ্ধির বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে এই উত্তেজনা বৃদ্ধির মূলে রয়েছে দুই দেশের পরস্পরবিরোধী কৌশলগত লক্ষ্য এবং দুদেশের পরস্পরকে দোষারোপের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি।
লাদাখের বিতর্কিত এই সীমান্ত এলাকা, যেটি খুবই প্রত্যন্ত এবং খুবই উত্তেজনাপ্রবণ, সেখানে ভারত দ্রুত যেভাবে নতুন সড়ক নির্মাণ করেছে, বিশ্লেষকরা বলছেন তা কোনরকম যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারতকে দ্রুত সৈন্য ও রসদ সরবরাহে বাড়তি সুবিধা দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের অবকাঠামো এভাবে আরও শক্তিশালী করার বিষয়টি বেইজিংকে আরও রুষ্ট করেছে বলেই তারা মনে করছেন। তারা বলছেন চীন এটাকে ভারতের দিক থেকে প্ররোচনামূলক বলে দেখছেন।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত